ডিজিটাল মার্কেটিং’ বলে আসলে কিছু নেই । Digital Marketing কথাটাই আমার কাছে একটা বিরাট ভুল ধারণা বলে মনে হয় ।
দাঁড়ান, দাঁড়ান । দয়া করে উপরের দু-লাইন পড়েই ডিজিটাল মার্কেটিংএর লোকজন আমাকে বকাবকি দেয়া শুরু করবেন না । ফ্রেন্ডলিস্টে অনেক ডিজিটাল মার্কেটিয়ারগণ আছেন । তাঁরাও রেগেমেগে আমাকে আনফ্রেন্ড করার আগে আরেকটু না হয় পড়ে নিন ।
আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে যখন প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা শুরু হয়, তখন প্রায় প্রতিটি শহর বা জনপদেই একটা খোলা চত্বর থাকত । যেখানে সাধারণ মানুষ যে কোনও বিষয়ে আলাপ করার জন্য জমা হতো, আবার সেখানেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কেনা-বেচার বাজার বসত । সেই খোলা জায়গাটিকে বলা হত ‘আগোরা’ । আস্তে আস্তে দেখা গেল কারও কিছু বিক্রি করার থাকলে, এমনকি কারও কোনও রাজনৈতিক বক্তব্য থাকলেও আগোরায় এসে দাঁড়িয়ে যায় । কখনও চিৎকার করে সবাইকে জানায় । আবার কখনও বা এখনকার প্যাম্পফ্লেট, পোস্টার বা দেয়াল লিখনের মত পশুর চামড়া-পাথর-দেয়ালের গায়ে লিখে রাখে – কখনও তাঁর পণ্যের গুণগান, দাম, পরিমান; আবার কখনও বা কারও বক্তব্যের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তি । আধুনিক পৃথিবীর আরও অনেক কিছুর মত ‘মার্কেটিং কম্যুনিকেশনের’ আদি ধারণাটা আর প্র্যাকটিসটাও বোধ করি আগোরার এই সব কাজকর্ম থেকেই এসেছে ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই শুরু থেকেই মার্কেটিং কম্যুনিকেশনের একটা মূলনীতি কিন্তু লক্ষ্য করা যায় ! কি সেটি ? খুব সিম্প্যল । সেটি হচ্ছে “ভীড় যেখানে, কথাও হবে সেখানে ।” যেহেতু লোক জমতো আগোরায়, সুতরাং কথা-বার্তা-বক্তৃতা-প্যাম্পফ্লেট-দেয়াল লিখন সবই হতো আগোরায় । আপনি একে কি বলবেন ? আগোরা মার্কেটিং ?
এরপর বহু শতাব্দী পর এলো ছাপাখানার রাজত্ব । কম্যুনিকেশনের মাধ্যম হিসেবে সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল ছাপা-কাগজের যুগ । সাহিত্য থেকে ধর্ম, জ্ঞান থেকে বিজ্ঞান, বিজ্ঞাপন থেকে রাজনৈতিক ধারণা সবকিছুই আশ্রয় নিল ছোট ছোট টাইপের অক্ষরে ।
তারপর এদিকের জগদীশ চন্দ্র বসু আর ওদিকের মার্কনী এনে দিলেন রেডিও’র যুগ । প্রথমবারের মত ছাপা লেখাকে ছাপিয়ে ‘শব্দ’ হয়ে উঠল কম্যুনিকেশনের মূল মাধ্যম । মুখের শব্দের সাথে যোগ করা হলো যন্ত্রের ছন্দ, যাকে আমরা বলি মিউজিক । কথা হয়ে উঠলো আরও উপভোগ্য । তারও পরে যোগ হলো নানা রকম যান্ত্রিক শব্দের আবহ । এসব এফেক্টের গুণে সাধারণ শব্দ হয়ে উঠল অসাধারণ ! শ্রোতার মনের আরও কাছে, আরও বেশী দাগ কাটার মত । ভয়েস আর্টিস্ট পেশাটার শুরু বোধ করি তখনই । সাথে সাথে আরেকটি অভাবনীয় জিনিষ শুরু হলো । মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবারের মত বিপুল সংখ্যক লোককে একই সাথে একই সময়ে জমায়েত করা গেল, অথচ তাঁদেরকে আক্ষরিক অর্থেই নাড়াচাড়া না করেই !!! ব্যস্ ! মার্কেটিয়াররা এই সুযোগ লুফে নিল । রেডিও হয়ে উঠল বিজ্ঞাপনের মূল মাধ্যম ! “ভীড় যেখানে, কথাও হবে সেখানে” ফর্মূলার দুর্দান্ত প্রয়োগ যাকে বলে ।
তারপর এলো মহা পরাক্রমশালী ‘টেলিভিশন’ । গানের ভাষায় যতই আমরা একে ‘বোকাবাক্স’ বলি না কেন, আসলে এই চারকোনা বাক্সটি কিন্তু উল্টো বোকা বানিয়ে ফেলল আমাদেরকেই । কোটি কোটি মানুষের কোটি কোটি জোড়া চোখ আঠার মত লেগে থাকল এই বাক্সের পর্দায় ! শব্দের সাথে ছবির কি অসাধারণ মিশ্রণ ! একে ভিত্তি করে তৈরী হলো সিনেমা নামের সম্পূর্ণ নতুন এক ইন্ডাস্ট্রি ! আর তৈরী হলো নতুন ধরণের মার্কেটিং কম্যুনিকেশন বা বিজ্ঞাপনের নতুন এক জোয়ার । সেই জোয়ার কতটা শক্তিশালী তা আমরা মার্কেটিয়ার মাত্রই খুব ভাল করেই জানি । নতুন করে ব্যাখ্যা করবার দরকার নেই ।
তারপর ? তারপর বিদ্যুতের ‘থাকা-আর-না থাকা’র অতিসাধারণ সংকেতকে বাইনারী সংখ্যার রুপান্তরিত করে হাজির হলো নতুন এক শক্তিমান দৈত্য । আমরা এর নাম দিলাম ‘ডিজিটাল সিস্টেম’ । মাইক্রোপ্রসেসর এই দৈত্যের হাতে দিল এক অসীম শক্তির যাদুর কাঠি ! ব্যস্ ! বদলে গেল পুরো দুনিয়া ! পৃথিবীজুড়ে শত শত কোটি মানুষ জড় হলো এই দৈত্যের রাজ্যে । গড়ে উঠল এক নতুন দুনিয়া, যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না । নাম ‘ভার্চুয়াল জগৎ’ । দিন নেই, রাত নেই এজগতের প্রতিটি মূহুর্তেই শত কোটি লোকের ভীড় । প্রতি মুহূর্তে জানিয়ে দেয়া যায় নতুন কিছু । তাও আবার প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে, যে যেভাবে যতটুকু চায় ঠিক সেভাবে ততটুকু ! কি অসীম সুযোগ ! মার্কেটিয়াররাও ঝাঁপিয়ে পড়ল আবার । যদিও মূল সুত্র কিন্তু সেই একই । “ভীড় যেখানে, কথাও হবে সেখানে ।” তিনহাজার বছর আগেকার সেই আগোরার সাথে একটুও পার্থক্য নেই ।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে তিনহাজার বছর আগের আগোরা কেন্দ্রীক মার্কেটিংকে কি আমরা ‘আগোরা মার্কেটিং’ বলব? ঠিক একইভাবে পরবর্তিতে ‘প্রিন্ট মার্কেটিং’ বা ‘টিভি মার্কেটিং’ বলেও আলাদা কোন টার্মের কথা শোনা যায় না । তবে ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’ বলে এখন আলাদা করছি কেন ?
এই কথা তুললাম কেন ? কারণটা বলছি ।
কারণটা হচ্ছে আস্তে আস্তে যেন মনে হচ্ছে ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’ বলতে বলতে এটিকে আমরা মূল মার্কেটিং থেকে আলাদা কিছু বলে মনে করা শুরু করে দিয়েছি । অথচ ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’ কিন্তু মোটেও আলাদা কিছু নয়, বরং মার্কেটিং এর একখানা অংশমাত্র । আমরা যেমন টিভিতে-রেডিওতে-আউটডোরে-প্রিন্টের জন্য় প্ল্যান করি, আমার কাছে ‘ডিজিটাল’ ঠিক সেরকমই একটা কম্যুনিকেশন চ্যানেল মাত্র । প্রতিটা চ্যানেলের যেমন নিজ নিজ বৈশিষ্ট, সুবিধা, অসুবিধা আছে, ডিজিটালেরও ঠিক তাই নিজস্ব বৈশিষ্ট, সুবিধা, অসুবিধা আছে । সেগুলো জেনে বুঝে ঠিকঠাক মত কাজে লাগানোটাই মার্কেটিয়ারের কাজ । সমস্যা হচ্ছে, কিভাবে কিভাবে যেন ডিজিটাল মার্কেটিং আলাদা ‘কিছু একটা’ হয়ে গিয়েছে । বিপদটা সেখানেই ।
কি বিপদ ?
আমি অনেককেই দেখেছি বছরের মার্কেটিং প্ল্যান করে দুটো – একটা ‘মার্কেটিং প্ল্যান’, আরেকটা ‘ডিজিটাল মার্কেটিং প্ল্যান’ । কি সাংঘাতিক ! আপনি যে দুটো প্ল্যান করছেন, তার মানে কি দুটো প্ল্যান দুভাবে কাজ করবে ? দুই উদ্দেশ্যে ? দুই টার্গেটকে সামনে রেখে ? দুই ক্রিয়েটিভ, দুই কম্যুনিকেশনকে ব্যবহার করবে ? অথচ, কনজ্যুমার কিন্তু সেই একই মানুষটা । যে লোকটা আপনার ব্র্যান্ডের কম্যুনিকেশন পেপারে দেখবে, রেডিওতে শুনবে, টিভিতে উপভোগ করবে, বিলবোর্ডে দেখবে; সেইই কিন্তু আবার মোবাইলে-ল্যাপটপে থাকবে । ভিন্ন কোনও লোক নয় । এখন ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’ আলাদা দুনিয়া বলে মনে করে আপনি যদি আলাদা উদ্দেশ্যে, আলাদা টার্গেট সামনে রেখে, আলাদা কথা-বার্তা তাঁকে শোনান-দেখান, তবে কিন্তু বেচারা শুধু কনফিউজড্ই হবে, এর চেয়ে ভাল কিছু নয় ।
অথচ, অনেক ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রেই দেখি তাঁদের নন-ডিজিটালে ব্যবহার, কথা-বার্তা, আচার-আচরণ একরকমের, আর ডিজিটালে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের ! নন-ডিজিটাল চ্যানেলে এক ধরনের পার্সোনালিটি, ডিজিটালে আরেকরকমের । একই ভাবে অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি স্ট্র্যাটেজী সমেত এমনকি টার্গেট কনজ্যুমার গ্রুপও বদলে গেছে ডিজিটালে এসে ! কি ভীষণ ভজঘট ! অথচ কনজ্যুমারের কাছে কিন্তু ডিজিটাল আর এ্যানালগ বলে আলাদা দুটো দুনিয়ার অস্তিত্ব নেই । তাঁর কাছে একটাই ‘আমি’, একটাই মস্তিষ্ক, একটাই থট প্রসেস, একটাই ডিসিশন মেকিং প্রসেস । ডিজিটাল হোক কিংবা এ্যানালগ – ডিসিশন মেকিং প্রসেসে কখনই সেই পার্থক্যটা আসে না । যেটি আসে সেটি হলো কি দেখেছি, কি শুনেছি, কি বুঝেছি । তাই যদি ডিজিটাল আর নন-ডিজিটাল মার্কেটিংএর নামে তাঁকে দুই রকমের কম্যুনিকেশনের ধাঁধায় ফেলে দেয়া হয় তবে আর যাই হোক ব্র্যান্ডের কোন উপকার হয় না, উল্টো ক্ষতি হয় ।
তাহলে কি করা উচিৎ ?
উপদেশে দেবার যোগ্যতা বা সাহস কোনটিই আমার নেই । তবে আমি কি করি সেটুকু বলতে পারি । আমি আমার মার্কেটিং প্ল্যান কে টোটাল মার্কেটিং প্ল্যান হিসেবেই দেখি – সবগুলো পি, কম্যুনিকেশ, ডিস্ট্রিবিউশন, কোম্পানী মিশন-ভিশন-ইনভেস্টমেন্ট ক্যাপাবিলিটি পুরোটাকে চিন্তা করে, এই সবগুলো সুতোকে একসাথে বুনেই আমি মার্কেটিং প্ল্যান করার চেষ্টা করি । ব্র্যান্ড কম্য়ুনিকেশন স্ট্রাটেজীও থাকে শুধু একটাই । অবজেক্টিভ অনুযায়ী সেটিকে কিভাবে মানুষের কাছে এফেক্টিভলি পৌঁছানো যায় সেটিকে সামনে নিয়েই তৈরী করা হয় কম্যুনিকেশন প্ল্যান । ডিজিটাল মার্কেটিং সেই প্ল্যানের গাড়িটাকে টানার একটা ঘোড়া মাত্র । টিভি-রেডিও-আউটডোর-প্রিন্টের মত অন্য সব ঘোড়ার সাথে ডিজিটালের ঘোড়াটাকেও অবশ্যই একই সাথে একই গাড়িটা একই দিকে টানার জন্য ছুটতে হবে । আলাদা কোন কিছু নিয়ে কিংবা আলাদা কোন দিকে নয় । তবেই না আমি রেসে জিতব ।
ডিজিটাল মার্কেটিয়ার বলতেও আমার কাছে তাই আলাদা কিছু নেই । আপনি ডিজিটাল বা নন-ডিজিটাল যেখানেই কাজ করেন না কেন, ফেসবুক-গুগল বা টিভি-রেডিও-পোস্টার যে মাধ্যমই ব্যবহার করেন না কেন, ব্র্যান্ড বিল্ডিংএর মূল সুত্রগুলো কিন্তু হবে একই – কনজ্যুমারকে নিজের হাতের তালুর মত করে চেনা, ব্র্যান্ডের পারপাস নির্ধারণ করা, পার্সোনালিটি ঠিক করা এবং যত কিছুই হোক তার কন্সিসটেন্সি বজায় রাখা । অর্থাৎ, আপনার কাজের ক্ষেত্র ডিজিটাল বা নন-ডিজিটাল যাই হোক না কেন, বেসিক মার্কেটিংএর এবং ব্র্যান্ডিংএর ব্যপারগুলো বুঝতে হবে, শুধু গুগল এ্যানালিটিকস, ফেসবুকের বায়িং প্যাটার্ন আর জিডিএন বুঝলে হবে না । ব্র্যান্ড না বুঝে যতই ডিজিটাল টেকনিক্যালিটি বুঝি, তাতে আর যাই হোক না কেন আদতে ব্র্যান্ডের কোন লাভ হবে না । তাই নিজেকে ডিজিটাল মার্কেটিয়ার না মনে করে, একজন মার্কেটিয়ার মনে করাটাই হবে বেটার Line of thought. ।
তাই Digital Marketing কথাটাই আমার কাছে একটা বিরাট ভুল ধারণা বলে মনে হয় । আমার কাছে ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’ নামে আলাদা কিছু নেই । ‘ডিজিটাল মার্কেটিয়ার’ নামেও আলাদা কেউ নেই । আছে শুধু ‘মার্কেটিং’ আর ‘মার্কেটিয়ার’ ।
#Marketing #DigitalMarketing #Communication #Professional #MarketingPlan
লিখেছেনঃ Galib Bin Mohammad