এরপর আমরা প্রতিদিন বনানীর একটি কফি হাউসে সারা দিন আড্ডা দিতাম। দুজন দুইটা ল্যাপটপ নিয়ে নানান পরিকল্পনার কথা বলি, অনেক হিসাব-নিকাশ করি। দুজনই ভেবেছি কীভাবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিপণনের কাজে সাহায্য করা যায়।’ তবে সেটি প্রচলিত ‘এজেন্সির মতো করে নয়।’ ‘আমরা বিপণনের কাজটা অটোমেটিক করতে চেয়েছি।’ আর এভাবে জন্ম হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ডিজিটাল বিপণন প্রতিষ্ঠান মার্কোপোলো এআই (https://www.markopolo.ai/)-এর।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ডিপ লার্নিং প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোগের কথা মনে হলে প্রযুক্তির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র সিলিকন ভ্যালির কথাই আমাদের মনে হয়। নিদেনপক্ষে ভারতের বেঙ্গালুরু বা ইউরোপের কোনো দেশ। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে এ দেশের তরুণ-যুবারাও সদর্পে এই পথে হাঁটতে শুরু করেছেন। বৈশ্বিক পণ্য লঞ্চিংয়ের প্ল্যাটফর্মে (Product Hunt) মার্কোপোলোর প্রোডাক্ট লঞ্চিংয়ের খবরটি আমাকে দিয়েছে আমার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে, কয়েক মাস আগে। বুঝেছি, আমরা খবর না রাখলেও তরুণদের নজর এসব দিকেই। তার পর থেকে আমি মার্কোপোলোর খোঁজ রেখেছি। এর মধ্যে আগস্টে তাদের বাড়িতে গমন আমার।
সিএনএন বিশ্বব্যাপী ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডিং প্রদর্শন করবে
গুলশান অ্যাভিনিউর বহুতল কাচ গুদামগুলোর মাঝখানে দোতলা বাড়িতে ঢুকেই চমকে গেলাম। কারণ, বাড়ির লন তো নয়, যেন এক বোটানিক্যাল গার্ডেন। নানা ধরনের অর্কিড, বনসাই ও লতাগুল্মের সমাহার। ভিন্ন এক পরিবেশে পরিপাটি একটি অফিস। কথা বলে জানলাম, প্রচণ্ড কাজের চাপে ফ্লোরে ঘুমাতেও কারও দ্বিধা নেই। কারণ, তাঁদের কাছে মার্কোপোলো কাজ নয়, স্বপ্ন। তাঁদের অফিসে কোনো স্যার/ম্যাডাম নেই। সবাই সমান। সেই মার্কোপোলোর অফিসে দুই সহ-প্রতিষ্ঠাতা তাসফিয়া ও রুবাইয়াতের সঙ্গে আমার আলাপচারিতা।
তাসফিয়া চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশনে পড়লেও পাস করার পর ওর কাজের ক্ষেত্র কোডিং থেকে দূরে। যদিও রোবটিকস ও মেকাট্রনিকস নিয়ে তিনি অনেক কাজ করেছেন শিক্ষাজীবনে। খুব অল্প সময়ে ডেটাসফট, এটুআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাসফিয়ার।
রুবাইয়াত পাস করেছেন বুয়েটের মেটালার্জি ও ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে। মাথায় সারাক্ষণ আইডিয়া ঘুরতে থাকে এই উদ্যোক্তার।
নাম নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা শেষে ইতালির পরিব্রাজক মার্কোপোলোর নামে নিজেদের উদ্যোগের নাম ঠিক করেন তাঁরা। তবে পরিব্রাজকের Marco polo-র নামের ‘সি’-এর জায়গায় ‘কে’ বসিয়ে দেন। এর ফলে ব্যাপারটা এমন হয় ‘Mr Mark is presenting your Marketing Plan’ হাসতে হাসতে বললেন তাসফিয়া।
মার্কোপোলো উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল বিপণনের কাজটাকে অটোপাইলটে নিয়ে গেছে। পণ্য বা সেবা, ব্যবসা এবং সেক্টর সম্পর্কে কিছু তথ্য পূরণ করে দিলে মার্কোপোলোর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ওই উদ্যোক্তার বিপণনকৌশল; প্রচারণা পরিকল্পনা; প্রচারণার কনটেন্ট; গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব বা ইনস্টাগ্রামে বিজ্ঞাপন প্রচারের সময়সূচি এবং বিজ্ঞাপন অপটিমাইজেশনের সবকিছু তৈরি করে ফেলে। ওদের পাশে বসে দেখলাম একটি বিস্কুটের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কৌশল ও শিডিউল ছাড়া পোস্টের ক্যাপশনও তৈরি করে দিয়েছে। বিজ্ঞাপন প্রচারের পর সেটির নানা তথ্য জানাসহ এসব বিষয় তত্ত্বাবধান করার জন্য মার্কোপোলো গ্রাহকদের একটি ড্যাশবোর্ড দিয়ে দিচ্ছে। ‘এ ছাড়া গ্রাহক চাইলে প্রস্তাবিত ক্যাপশন, ছবি কিংবা পরিকল্পনাও নিজের মতো সাজিয়ে নিতে পারে,’ রুবায়েত জানান।
গুগল, ফেসবুক বা ইউটিউব প্রতিনিয়ত তাদের অ্যালগরিদমের নানা পরিবর্তন করে। একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পক্ষে সবকিছু সামলে সে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সময় বের করাটা কঠিন। আবার সময় পেলেও এসব বিষয়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করা মোটেই সহজ নয়। মার্কোপোলো এই সব বিষয় থেকে তাকে মুক্তি দেয়।
ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিংয়ে (NLP) এখনো বাংলার স্থান পোক্ত হয়নি। ফলে মার্কোপোলোর সেবা এখনো ইংরেজিতে। ‘তবে আমরা কাজ করছি বাংলা যুক্ত করার,’ বলেন তাসফিয়া।
ইংরেজিতে হওয়ার কারণে মার্কোপোলোর উদ্যোগ সহজেই বৈশ্বিক উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর আমেরিকা, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য কাজ করতে শুরু করেছে মার্কোপোলো। এই প্রতিষ্ঠানগুলো শপিফাই বা আমাজনের এফবিএ মার্চেন্ট। ‘তবে আমাদের লক্ষ্য দক্ষিণ এশিয়া। ইন্দোনেশিয়া দিয়েই আমরা শুরু করেছি। এ অঞ্চলে ই-কমার্স ও অনলাইন ব্যবসা দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। শপির (Shopee) মতো বৃহৎ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি আমরা এখন,’ জানান দুই উদ্যোক্তা। (সোর্স প্রথমআলো)