করোনা মহামারির কারণে ব্যবসার ধরন, গ্রাহকের আচরণ—সব কিছুতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে ব্যবসার ডিজিটাল রূপান্তর করছেন অনেকেই। অনলাইনকেন্দ্রিকে সেবায় ভোক্তার অভ্যস্ততা তৈরি হওয়ায় ব্যবসার কৌশল বদলাচ্ছেন অনেকেই। দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতেও ব্যবসা চালু রাখতে সনাতন পদ্ধতির পাশাপাশি ই-কমার্সে প্রবেশ করছে বিভিন্ন কম্পানি। উদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যবসার ব্যয় কমিয়ে উৎপাদন বাড়াতে তাঁরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) সহায়তা নিচ্ছেন। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ও নীতি সহায়তার পাশাপাশি প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা পুনরুদ্ধারে সর্বশক্তি নিয়ে নেমেছেন তাঁরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে ই-কমার্সের বাজার বেশ ভালো আকার ধারণ করেছে গত মার্চের শেষের দিকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে। করোনা প্রতিরোধে মানুষ চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় বাসায় বসে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে পণ্য কেনাকাটা শুরু করে। এ সময় পাঠাও, দারাজ, চালডালডটকম, সহজডটকম, ফুডপান্ডা, বাগডুমডটকম, আজকেরডিলডটকম, বিক্রয়ডটকম, সেবাএক্সওয়াইজেডের মতো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ঘরে পণ্য পৌঁছে দেয়। দেশে ই-কমার্স ব্যবসার প্রসারে সহায়তা করেছে মোবাইল ব্যাংকিং এবং অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু থাকার কারণে।
জানতে চাইলে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ তমাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মহামারিতে ই-কমার্সের চাহিদা অনেকটা বেড়েছে। এই খাতে নতুন ক্রেতা ও উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। এই খাতের অবকাঠামো তৈরিতে বিনিয়োগ বাড়ছে।’
তিনি বলেন, মহামারির আগে যেখানে দৈনিক ই-কমার্স ডেলিভারির সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের মতো। এখন এক লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ পর্যন্ত ডেলিভারি হচ্ছে। গত বছর বার্ষিক টার্নওভার ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা, যা এ বছর অনেক বাড়বে।
দেশে বছরে এক লাখ কোটি টাকার ওপরে খুচরা বিক্রি হয়, যেখানে সুপারশপগুলোর বার্ষিক টার্নওভার দুই হাজার কোটি টাকার মতো। এসিআই লজিস্টিকস লিমিটেডের (স্বপ্ন) নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মার্চ মাসে দেশে যখন করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়, ঢাকা শহরের কাঁচাবাজারের বিক্রেতাদের একটি বড় অংশ গ্রামে চলে গিয়েছিল। সেই সময় পণ্যের একটি অংশ জোগান দিয়েছে ই-কমার্স ও সুপারশপ। আমরাও ই-কমার্স সেবা নিয়ে গ্রাহকের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমাদের ই-কমার্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২০ শতাংশের বেশি। এ কারণে আমরা ই-কমার্স ব্যবসা ঢেলে সাজাচ্ছি। আগামী ছয় মাসে আমরা ব্যাপক বিনিয়োগ করতে থাকব। সারা দেশে স্বপ্নের ওয়্যারহাউস সম্প্রসারণ, স্টোরে বিনিয়োগসহ আরো জনবল নিয়োগ করব।’
সাব্বির হাসান নাসির বলেন, ‘করোনার আগে আমাদের ই-কমার্স সেবাটি ক্ষুদ্র পরিসরে ছিল, যেটা আমরা বেশ উন্নয়ন করেছি। আমাদের অনলাইন স্বপ্নডটকম ও পার্টনার্স চ্যানেলে প্রায় ২৫ শতাংশ হোম ডেলিভারির মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে।’
করোনাভাইরাসের প্রভাবে পোশাকে চার হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে জানালেন সাদাকালোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজহারুল হক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস দেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে বড় বিপদের মুখে ফেলেছে। আমরা মহামারির শুরুর দিকে অনলাইন, ফেসবুক পেজে অর্ডার নিয়ে তা সরবরাহ করেছি।’
এদিকে পোশাকের মতো অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে ইলেকট্রনিক পণ্য, মোবাইল ফোন, পাদুকাসহ আরো অনেক কিছু। এ ছাড়া পাদুকা ব্র্যান্ড বাটা, এপেক্সসহ অন্যরা অনলাইনেও পণ্য বিক্রি করছে। ইলেকট্রনিকস পণ্যের ক্ষেত্রে শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলো অনলাইনে টিভি, ফ্রিজসহ গৃহস্থালি পণ্য বিক্রি করছে।
জানতে চাইলে দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ই-জেনারেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনাকালে অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রিমোর্ট ওয়ার্কিং টুলের ব্যবহার শুরু করেছে। কেউ কেউ ওয়ার্কফ্লো ম্যানেজমেন্টসহ কিছু বেসিক সফটওয়্যার নিয়েছে। তবে এখনো বিরাট অংশই অটোমেশনের বাইরে আছে। তারা বুঝতে পারছে না, এমন আপদ যেকোনো সময় আসতে পারে, এগুলোর জন্য ব্যবসাকে প্রস্তুত রাখা দরকার। প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর গুরুত্ব এখনো অনেক ব্যবসায়ী বুঝতে পারছেন না। স্বাস্থ্য খাতে ইলেকট্রনিক মেডিক্যাল রেকর্ডসহ রোগীদের সেবা দেওয়ার এখনো প্রযুক্তির ব্যবহার কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়েনি। আমাদের মহামারি থেকে শিক্ষা নিয়ে জেগে ওঠা দরকার।’
তিনি বলেন, এখনো কম্পানির টপ ম্যানেজমেন্টের মধ্যে ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশন নিয়ে এক ধরনের ভীতি আছে। তারা এ ক্ষেত্রে কম্পানির আইটি প্রধানের ওপর নির্ভরশীল। এই বিষয়ে তাদের সচেতন হওয়া দরকার, প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।
সফটওয়্যার রপ্তানিকারকদের সংগঠন বেসিসের সাবেক সভাপতি ও ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস আজকেরডিলডটকমের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রথম দিকে ই-কমার্সে নিত্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছিল, যা পরে কিছুটা কমেছে। করোনার কারণে মানুষের অনলাইনের অভ্যস্ততা দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের সহায়তা করবে। ই-কমার্স সেবা এখনো প্রধানত শহরকেন্দ্রিক, যেটা গ্রাম পর্যন্ত নিতে অবকাঠামো উন্নয়ন দরকার।’
তবে করোনা মহামারিতে উৎপাদন ও বিক্রি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সংক্রমণ কমায় দেশের বড় বড় শপিংমল ও মার্কেটগুলো পুরোদমে খুললেও ক্রেতা উপস্থিতি এখনো কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়েনি। করোনায় দীর্ঘ সময় দোকান খুলতে না পেরে কেউ কেউ অনলাইনে ব্যবসা ধরে রেখেছেন। দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশই ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের বাইরে আছে।
প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা কাজে লাগিয়ে কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ এবং স্টার্টআপের মতো ব্যাবসায়িক উদ্যোগের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে ‘এফবিসিসিআই টেক সি’ নামে একটি প্রযুক্তি কেন্দ্র চালু করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। গত ৬ ডিসেম্বর ফেডারেশন ভবনে নতুন এই উদ্যোগ উদ্বোধন করা হয়। এটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যবসার ডিজিটাইজেশনে সহায়ক হবে আশা করা হচ্ছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, করোনাকালে ডিজিটাইজেশনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে সারা বিশ্ব। বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে প্রযুক্তিনির্ভর কার্যক্রমে আরো বেশি সম্পৃক্ত হতে হবে। নতুন এই প্ল্যাটফর্ম সারা দেশের উদ্যোক্তাদের সহায়তা করবে।
কালের কন্ঠ