Written by 9:25 pm Brand Practitioners, Buzz, Market Research, News

ব্র্যান্ড পার্সোনালিটির আত্মহত্যা !

0
Walton and Herlan Ads

গত বছর ঠিক ঠিক এই সময়টাতে সুইডেনের স্টকহোমে বিখ্যাত IHM Business School এ আমি Marketing Communication এর উপর একখানা কোর্স করছিলাম । এই কোর্সে আরলা থেকে পাঠানো আমি সহ আরও ছিলেন ৮ টি দেশের সিলেক্টেড ১০ জন সিনিয়ার মার্কেটিয়ারগণ । আর Instructor হিসেবে ছিলেন বিশ্বখ্যাত FMCG জায়েন্ট Procter & Gamble (P&G) এর একসময়ের গ্লোবাল ব্র্যান্ড ডিরেক্টর মাইকেল ক্লায়ার । ভদ্রলোকের বয়স এখন ৭০ এর বেশী । কিন্তু যখন কথা বলেন মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যেতে ইচ্ছে করে !
.
প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকেই মাইক প্রশ্ন করল “আচ্ছা, Strategy মানে কি ?” আমরা যে যার মত করে উত্তর দিলাম – কেউ বইয়ের সংজ্ঞা থেকে, কেউ বা নিজের মত করে । সবারটা শুনে মাইক হাসল । তারপর বলল “আমার কাছে Strategy মানে খুব সিম্পল – Sacrifice (স্যাক্রিফাইস) ।”

“কিভাবে ?” মাথা চুলকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম ।

“শোনো, তোমার কাছে যখন পথ আছে সাকুল্যে একটাই, তখন তোমার চিন্তা-ভাবনা করে পথ সিলেক্ট করার দরকার নেই । কারণ তোমার হাতে ঐ একটি বাদে কোনো অপশনই নেই । ঘটনা যাই হোক তোমাকে সেই একটিমাত্র পথেই চলতে হবে, চলতে তুমি বাধ্য । কিন্তু তোমার হাতে যখন একাধিক পথ আছে, তখন তোমার চিন্তা-ভাবনা করে বের করতে হবে তুমি কোন পথে যাবে । অর্থাৎ, তোমাকে Strategy ঠিক করতে হবে । আর তুমি যখন একটামাত্র পথ বেছে নিবে, তার মানে হলো অন্যপথগুলো তুমি Sacrifice করছ তোমার বেছে নেয়া পথটিতে চলার জন্য । এই ‘Sacrifice’ই হচ্ছে ‘স্ট্রাটেজি’ । তুমি যদি স্যাক্রিফাইস করতে না পার, তবে তুমি কখনই স্ট্র্যাটেজী বানাতে পারবে না । তোমার অবস্থা হবে ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’র মতন ।”

সেই থেকে তিনদিন ধরে টানা চলেছিল মাইকের চমৎকার লেকচার, অসংখ্য কেস স্টাডি, দারুন সব ক্লাস এক্সারসাইজ আর হোমওয়ার্ক । আমার জীবনে মার্কেটিং উপরে করা সবচেয়ে সেরা কোর্স ছিল এটি !
.
একবছর পর এই কোর্সের কথা মনে পড়ল কেন ?

0 1

মনে পড়ল গত পরশু Lux এর এই কম্যুনিকেশনটি দেখে । Lux শুধু এশিয়ার নয়, বরং গায়ে-মাখা সাবানের ক্যাটাগরীতে বলা যায় পৃথিবীর সবচেয়ে স্ট্রং ব্র্যান্ডগুলোর একটি । এই পজিশনে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় যে জিনিষটি কাজ করেছে সেটি হচ্ছে Lux ব্র্যান্ডের পার্সোনালিটি – ‘Liberal, Inspirational, Feminine and Glamorous’ এবং এই পার্সোনালিটিকে রীতিমত খুঁটিগেড়ে এক জায়গায় ধরে রাখা (consistency) । গত ৫০ বছরের বেশী সময় ধরে লাক্স হাজার হাজার কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছে এই পার্সোনালিটিটি তৈরী এবং দারুন মজবুতভাবে কোটি কোটি মানুষের মনে গেঁথে দেবার জন্য । ইউনিলিভারের মার্কেটিং স্ট্রাটেজির এই consistency আমার সবসময়ই ভীষণ ভাল লাগে ! ব্র্যান্ড পার্সোনালিটির ব্যপারে এদের ইনভেস্টমেন্ট এবং consistency রীতিমত হিংসা করার মত ! যুগের পর যুগ ধরে পৃথিবীর এতগুলো দেশে ছড়িয়ে থাকা একখানা ব্র্যান্ডের পার্সোনালিটি এত consistent ভাবে এত বছর ধরে ঠিক রাখা মুখের কথা নয় ! যারা জীবনে গ্লোবাল ব্র্যান্ড হ্যান্ডেল করেছেন শুধু তারাই এর চ্যালেন্জ এবং জটিলতাগুলো কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন ।
.
ঠিক এ কারণের ধাক্কা লাগল এই এ্যাড খানা দেখে – “Protect from germs. Stop the germs” ইত্যাদি ইত্যাদি ! লাক্সের ব্র্যান্ড পার্সোনালিটির কোথাও তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ‘Protection’ কিংবা ‘Germ protection’ এই ধরণের কিছু পাওয়া যাবে না; এটি বরং ‘লাইফবয়’ ব্র্যান্ডের এলাকা । লাক্সের “লিবারাল, ইন্সিপিরেশনাল, ফেমিনিন এবং গ্ল্যামারাস” পজিশনের সাথে ‘Protection’ কিংবা ‘Germ protection’ কোনভাবেই যায় না, বরং বিপরীতমুখী একখানা ধাক্কা দেয় । লাক্সের ইতিহাস ঘেটে দেখুন – কস্মিনকালেও লাক্স প্রোটেকশন জাতীয় কম্যুনিকেশন করেছিল কি না অন্ত:ত আমার জানা নেই । জানি যুক্তি দেখাবেন যেন করোনার সময়ে যখন ‘জার্ম প্রোটেকশন’ আম জনতার জন্য রিলেভেন্ট ইস্যু, তখন সাবানের ব্র্যান্ড হিসেবে Lux এটি বলতেই পারে । ক্ষতি কি ?
.
ক্ষতি আছে । এখানেই আবার মনে পড়ল মাইকের কথাগুলো । মাইক বলছিল “তুমি প্রায়ই দেখবে তোমার প্রোডাক্ট শুধু একটি কাজ নয় বরং অনেক কিছুই করতে পারে । আর মানুষ হিসেবে তোমার সবসময়ই মনে হবে সবগুলো বললে ক্ষতি কি ! মিথ্যে তো আর বলছি না । যত বেশী বলব, তত বেশী লোকের কাছে পৌঁছতে পারব । তবে ‘মানুষ’ হিসবে না পারলেও অন্ত:ত একজন মার্কেটিয়ার হিসেবে এই টেম্পটেশনটি থেকে তোমাকে দূরে থাকতেই হবে । কারণ, যেই মাত্র তুমি অনেক কিছু বলা শুরু করবে, সেই মাত্র তোমার ব্র্যান্ডের পার্সোনালিটি তুমি এলোমেলো করা শুরু করবে । যত বেশি জিনিষ বলবে, কনজ্যুমারদের কাছে তত বেশী কনফিউজিং হবে । সে বুঝে উঠতে পারবে না যে এই কারণ, না ঐ কারণ – ঠিক কি কারণে সে তোমার ব্র্যান্ড কিনবে ! তাই যত যাই ঘটুক না কেন তোমাকে তোমার ব্র্যান্ডের পার্সোনালিটি আর কোর USP (Unique Selling Proposition) -তে শক্ত হয়ে consistent থাকতেই হবে – দুনিয়া উল্টে গেলেও ।”
.
প্রশ্ন করতে পারেন – ব্র্যান্ড কি তবে হঠাৎ আসা সুযোগ নিবে না ? উত্তর হলো অবশ্যই নিবে তবে তা কোনোভাবেই তার পার্সোনালিটির বারোটা বাজিয়ে নয় । কারণ Opportunity আসে সাময়িক সময়ের জন্য কিন্তু পার্সোনালিটির প্রভাব রয়ে যায় অনেক অনেক লম্বা সময়ের জন্য, যেটি ব্র্যান্ডের ইকুইটিতে বিরাট প্রভাব ফেলে । তাই Short-term লাভের জন্য long-term ‘ব্র্যান্ড ইকুইটি’র ক্ষতি করা আত্নহত্যার মত । তাই সব সুযোগে সবার ঝাপিয়ে পড়াটা ঠিক নয় । এতে দিন শেষে বরং লাভের চাইতে ক্ষতিই বেশী হয় ।
.
লাক্সের এই কম্যুনিকেশন যদি কন্টিনিউ করে তবে তা লাক্সের কোর কনজ্যুমারদের মনে এর ব্র্যান্ড পার্সোনালিটির ব্যপারে একটা খটকা তৈরী করবে ! ব্যপারটা সাইকোলজিক্যাল । এই খটকা এমনকি এই কম্যুনিকেশন এখন বন্ধ করে দিলেও কিন্তু অনেকের মনের গভীরে রয়েই যাবে, হয়ত অনেক অনেক দিন ধরে । যেটি প্রভাব বিস্তার করবে ব্র্যান্ড হিসেবে লাক্সের বিশ্বাসযোগ্যতার উপর । কারণ, মানুষ দ্বিধায় থাকবে লাক্সকে সে ঠিক কিভাবে দেখবে – একজন Liberal, Glamorous, Inspiration, Feminine ব্যক্তি হিসেবে ? না কি প্রটেকশন দিতে পারে এমন একজন শক্তিশালি লোক হিসেবে (যেটি সাধারণভাবে ফেমিনিন বা গ্ল্যামারাস নয়) ?
.
ধরুন আপনার এক বন্ধু যিনি কিনা খুব শান্তশিষ্ঠ, নিরীহ টাইপের, নিপাট ভদ্রলোক, তাঁকে যদি হঠাৎ দেখেন পথের মোড়ে কারও সাথে মারামারি করছে তখন নিশ্চয়ই একটা ধাক্কা লাগবে – “আরে ও তো এমন না । তবে হঠাৎ মারামারী করছে কেন?” আবার অন্যদিকে ধরুন পাড়ার বখাটে ছোঁড়াটা, কলার উঁচিয়ে সারাদিন মুখে সিগারেট দিয়ে আশেপাশের নিরীহ লোকদের চর-চাপড় দিয়ে পাতিনেতাগিরী ফলানোই যার নিত্যদিনের কাজ, সে যদি হঠাৎ শান্ত-শিষ্ঠ, সুবোধ ছেলের মত সভ্য কাপর-চোপর পরে পথে আপনাকে সালাম দিয়ে বসে, আপনি কিন্তু তাতে একটুও স্বস্থি বোধ করবে না । বরং ভাবতে বসবেন কি যেন নতুন ঘোট পাকাচ্ছে ব্যাটা !
.
ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রেও ব্যপারখানা ঠিক তাই । ব্র্যান্ড যখন হঠাৎ করে তার চরিত্রের (Personality) বাইরে গিয়ে কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম করা শুরু করে তখন মানুষের মনে ঠিক এরকমই একটা খটকা, একটা দ্বিধা তৈরী হয় । কনজ্যুমারের মনের ভেতরের এই দ্বিধাটা যেকোন ব্র্যান্ডের জন্য অত্যন্ত খারাপ বিষয় । এটি ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দেয়া । এর প্রভাব পরবে পারচেজ ডিসিশনে, অর্থাৎ দিন শেষে সেলস নম্বরে । সুতরাং, একটা Opportunity ধরতে গিয়ে ব্র্যান্ড কিভাবে লংটার্মে নিজের ক্ষতি করে ফেলতে পারে সেটির একটা উদাহরণ এটি !
.
প্রশ্ন হচ্ছে লাক্সের ব্র্যান্ডটিম এই ভুলটা করল কেন ? তা কি এই সুক্ষ্ন ব্যপারগুলো জানেন না ? অবশ্যই জানেন । ইউনিলিভার বিশ্বের সেরা House of Brands এর একটি । এখানকার মার্কেটিং টিম আমার চাইতে অনেক অনেক বেশী জ্ঞানী এবং চৌকষ সে ব্যপারেও আমি নিশ্চিত । তবে ? কারণটি হলো নিজের টেম্পটেশনটাকে ধরে রাখতে না পারা । ব্র্যান্ড ম্যানেজার শত হলেও মানুষ তো । এখানে মার্কেটিয়ারের সাথে মানুষের লড়াই ‘মানুষ’ জিতে গিয়েছে, হেরে গিয়েছে ‘মার্কেটিং মাইন্ড’। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি ইউনিলিভারের মত মাস্টার প্লেয়ারের কাছ থেকে এইরকম নবিশ একটা ভুল আশা করিনি । তার উপর যাদের হাতে লাইফবয়ের মত শক্টিশালী এবংএই পরিস্থিতির জন্য একদম উপযোগী একখানা ব্র্যান্ড আছে, যার সম্পূর্ণ পজিশনই কি না জার্ম-প্রটেকশনের উপর ভিত্তি করে । সুতরাং, এই পরিস্থিতিতে লাক্সকে এই ভুল জায়গায় টেনে না নামালেও কোম্পানীর overall বিজনেসে কোনও ক্ষতি হতো বলে আমার মনে হয় না ।

0 2
অনেকেই আবার যুক্তি দেবেন এই বলে যে এটি তো ‘ব্র্যান্ড বিল্ডিং’ কোনও ক্যাম্পেইন নয়, বরং সাধারণ একখানা ট্যাকটিক্যাল ক্যাম্পেইন । তাই এমন কি আর ক্ষতি হবে ? আসলে ‘ব্র্যান্ড বিল্ডিং ক্যাম্পেইন’ আরে ‘ট্যাকটিক্যাল ক্যাম্পেইন’ নামে আলাদা কিছু নেই । মাইক একটা দারুন রুপক দিয়ে বুঝিয়েছিল – “তোমার ব্র্যান্ডের ইকুইটি (Authenticity + Trust + Value) যা আসে তার ‘পার্সোনালিটি আর ইমেজ’ থেকে, সেটি অনেকটা ব্যাংক এ্যাকাউন্টের মত । যতবার ব্র্যান্ডে কোনো কথা বলবে – তা সে ছোটই হোক কিংবা বড় কিছু, বা কোন এ্যাক্টিভিটি করবে তা সে যত লম্বা সময়ের জন্য কিংবা সামান্য কয়েকঘন্টার জন্য, সেটি ব্র্যান্ডের এ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সশিটে ইম্প্যাক্ট ফেলবে । যদি ব্র্যান্ডের কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম তার পার্সোনালিটি-ইমেজের সাথে মিলে তবে তা ব্র্যান্ডের ব্যালেন্সে যোগ হবে – অর্থাৎ, ইকুইটি বাড়বে । আর যদি না মিলে তবে ব্যালেন্স থেকে বিয়োগ যাবে – অর্থাৎ, ইকুইটি কমবে ।”
.
তাই ‘ব্র্যান্ড বিল্ডিং’ কিংবা ‘ট্যাকটিক্যাল’ – এগুলো কিন্তু ব্র্যান্ড ম্যানেজারের নিজস্ব definition । একজন সাধারণ কনজ্যুমারের জন্য কিন্তু যা কিছু বলা বা করা হচ্ছে সেটিই ব্র্যান্ডের বক্তব্য, তার পরিচয়, পার্সোনালিটি, ইমেজ । সুতরাং, সাবধানে ভাবতে হবে শুধু বড় ব্র্যান্ড বিল্ডিং থীমেটিক ক্যাম্পেইনে কিন্তু ট্যাকটিকাল ক্যাম্পেইনে যা খুশী বলা যায় – এটি আমার কাছে সম্পূর্ন ভুল বলে মনে হয় ।
.
তাই, দিন শেষে আপনার ব্র্যান্ডকে আপনি সাময়িক সেলস্ নম্বরের টেম্পটেশনের জন্য বলি দেবেন, না কি শত শক্ত সময়েও বুকে আগলে রেখে তাকে বেঁচে থাকতে দেবেন সেই সিদ্ধান্তখানা আপনাকেই নিতে হবে । কারণ পুরো প্রতিষ্ঠানে ‘ব্র্যান্ড’ নামক এই ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী এ্যাসেটটির অভিভাবক কিন্তু আপনিই, মানে আমরা যারা মার্কেটিংএ আছি; আর কেউ নয় ।

লিখেছেনঃ Galib Bin Mohammad,Head of Marketing, Arla

 

Share this on
Close