রাজধানীর খিলক্ষেতে স্বপ্না আক্তারের ছোট্ট সংসার। দুই মেয়ে স্কুলে পড়াশোনা করে। স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বেতন অল্প। তাই সংসারে টানাটানি। সচ্ছলতা ফেরাতে বছর পাঁচেক আগে দুই লাখ টাকা বিনিয়োগে সাদিয়া স্টোর নামে মুদির দোকান দেন স্বপ্না। ব্যবসা মোটামুটি চললেও টুকটাক ঝামেলা লেগেই ছিল। পণ্য আনতে গেলে দোকান বন্ধ রাখতে হয়। মাঝেমধ্যে অর্থের অভাবেও প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারেন না। পণ্য না পেয়ে ক্রেতাদের কেউ কেউ অন্য দোকানে চলে যেতেন।
বছরখানেক আগে স্বপ্না আক্তারের পাশে এসে দাঁড়ায় শপআপ নামের একটি উদ্যোগ। তারপর থেকে মুদিপণ্যের জন্য আর দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় না স্বপ্নার। যখন যে পণ্য লাগে, সেটি অনলাইনে ক্রয়াদেশ দিলেই দোকানে পৌঁছে যায়। অর্থের টান থাকলেও সমস্যা নেই। বাকিতেও পণ্য কেনা যায়। মূলত তিনটি ভিন্ন সেবার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের নানা রকম সমস্যার সমাধান দিচ্ছে শপআপ।
স্বপ্না আক্তার গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বললেন, ‘শপআপের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর আমার ব্যবসা পরিচালনা অনেক সহজ হয়েছে। পণ্য কিনতে যাওয়ার কারণে দোকান বন্ধ রাখতে হচ্ছে না। প্রয়োজন হলে বাকিতেও পণ্য কেনা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যবসা কিছুটা হলেও বেড়েছে।’
স্বপ্নার মতো সারা দেশের ৮-৯ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার কাছে পৌঁছে গেছে শপআপ। এই স্টার্টআপ নতুন করে সাড়ে সাত কোটি মার্কিন ডলার বা ৬৪০ কোটি টাকার বড় বিনিয়োগ পেয়েছে। ১০ মাসের ব্যবধানে শপআপে এটি দ্বিতীয় বিদেশি বিনিয়োগ। আর্থিক সেবা মাধ্যম পেপ্যালের সহপ্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েলসহ তিনজনের প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড ভালার ভেঞ্চারসের নেতৃত্বে এই বিনিয়োগে আরও রয়েছে প্রসুস ভেঞ্চারস, ফ্লারিশ ভেঞ্চারস, সেকুইয়া ক্যাপিটাল ইন্ডিয়া এবং ভিওন ভেঞ্চার্স।
শপআপ কর্তৃপক্ষ গতকাল সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিনিয়োগের বিষয়টি ঘোষণা দিয়েছে। তারা বলেছে, সিরিজ বি হিসেবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার বিটুবি কমার্সভিত্তিক যেকোনো স্টার্টআপে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। গত অক্টোবরে ১৯০ কোটি টাকার ‘সিরিজ এ’ বিনিয়োগ পেয়েছিল শপআপ। মূলত নতুন কোনো উদ্যোগ যখন প্রাথমিক পুঁজি নিয়ে বাজারে ভালো ফল দেখায়, তাদের ক্ষেত্রে সিরিজ এ শ্রেণির বিনিয়োগ করা হয়। তারপরের ধাপে হয় সিরিজ বি বিনিয়োগ। সব মিলিয়ে শপআপে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াল ৯৩৫ কোটি টাকার বেশি, যা বাংলাদেশের যেকোনো স্টার্টআপে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ।
শপআপের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আফিফ জামান প্রথম আলোকে বলেন, ৬৪০ কোটি টাকার নতুন এই বিদেশি বিনিয়োগ শপআপের জন্য একটি মাইলফলক। তা ছাড়া বাংলাদেশের স্টার্টআপের জন্য দরজা খুলে গেল। পিটার থিয়েলের ভালার ভেঞ্চারসের ধারাবাহিকতায় বিশ্বের অন্যান্য বড় বড় বিনিয়োগকারী ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আসবে।
শপআপের শুরুর গল্প
আফিফ জামান ও সিফাত সারওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) থেকে বিবিএ করেন। এরপর সিফাত সারওয়ার যোগ দেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে আর আফিফ জামান গড়ে তোলেন নিজের একটি ব্যবসা। সেখানেই পরিচয় হয় আতাউর রহিম চৌধুরীর সঙ্গে। আতাউর রহিম ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটারবিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিভাগ থেকে পাস করেছিলেন।
২০১৮ সালে পটুয়াখালীর দাদাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আফিফ দেখেন গ্রামের কারুশিল্পীরা প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈজস তৈরি করেন, কিন্তু প্রাপ্য দাম পান না। ওই সব কারুশিল্পীকে সহায়তা দেওয়ার উদ্দেশ্য থেকেই তাঁরা একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করেন। সেখান থেকেই শুরু শপআপ। বর্তমানে শপআপে আফিফ জামান সিইও, আতাউর রহিম চৌধুরী প্রধান পণ্য কর্মকর্তা, সুজায়াত আলী প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা এবং নাভনীত কৃষ্ণান প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন।
শপআপ শুরুতে ব্র্যাকের সঙ্গে অংশীদারত্বে ঋণ দেওয়া শুরু করলেও খুব দ্রুতই ভারতের ওমিডিয়ার নেটওয়ার্ক থেকে প্রাথমিক তহবিল পায়। এ দিয়েই একটু একটু করে এগোতে থাকে শপআপ। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের সেরা স্টার্টআপ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার পায় শপআপ।
শপআপের তিন সেবা
মোকাম, রেডএক্স ও বাকি নামে তিনটি সেবা রয়েছে শপআপের। বিটুবি ব্যবসার অ্যাপ মোকামের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টার মাধ্যমে পাড়ার মুদিদোকানে নিত্যপণ্য পৌঁছে দেয় শপআপ। এ জন্য বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, পরিবেশক ও পাইকারদের সঙ্গে চুক্তি করেছে এই স্টার্টআপ। তা ছাড়া রেডএক্সের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হয়। গত বছর যাত্রা শুরু করা রেডএক্স বর্তমানে ৪৯৩ উপজেলায় সেবা দিচ্ছে। আর ‘বাকি’ সেবার মাধ্যমে বাকিতে পণ্য কিনতে পারেন ছোট ব্যবসায়ীরা।
সুনামগঞ্জের তাহেরপুরের মো. জাহাঙ্গীর ২০ বছর ধরে মুদিদোকানের ব্যবসা করেন। তাঁর দোকানের নাম সততা স্টোর। ছয় মাস আগে শপআপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তিনি। গতকাল মুঠোফোনে বললেন, ‘আগে ভৈরব থেকে নৌকায় করে পণ্য আনতে হতো। অনেক সময় লাগত। বর্তমানে শপআপের কারণে দোকানে বসেই পণ্য পাচ্ছি। সে কারণে পণ্যের দামও কিছুটা কম পড়ছে।’
শপআপ জানায়, গত ১২ মাসে শপআপের ব্যবসা ১৩ গুণের বেশি বেড়েছে। আর পণ্য সরবরাহের সংখ্যা বেড়েছে ১১ গুণ। গত বছর শপআপ ভারতের বেঙ্গালুরুতে অফিস চালু করেছে। বেঙ্গালুরুর কোম্পানি ভুনিক অধিগ্রহণও করেছে তারা।
শপআপের সিইও আফিফ জামান বলেন, ‘আমাদের দেশে ছোট ছোট প্রায় ৪৫ লাখ ছোট ব্যবসায়ী বা মুদিদোকানি আছেন। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় তারাও ধীরে ধীরে অনলাইনে আসতে শুরু করেছে। অনলাইনে ব্যবসা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের টুলসের প্রয়োজন হয়। আগামী এক দশক আমরা ব্যবসায়ীদের সেই সুবিধা দেওয়ার জন্য শপআপে নতুন নতুন ক্যাটাগরি যুক্ত করব। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের অর্থায়নের সমস্যা সমাধানে আরও জোর দেওয়া হবে।’