Communication জিনিসটি যত সহজ বলে মনে হয়, আদতে মোটেও তত সহজ নয় ।
বাসার বুয়া কাজে এসেছেন প্রায় মাস খানেক পর ।
জিজ্ঞাসা করলাম “বুয়া, সামাজিক দূরত্ব মানছেন তো ?”
“কি যে কন ভাইয়া ! গরীব মানুষের আর সমাজ !” আমাকে কিছুটা আক্কেল গুড়ুম করে দিয়ে বুয়ার উত্তর !
.
সেদিন বেরিয়েছিলাম কাজে বনানী ১১ নম্বরে । হেঁটে হেঁটেই । ফেরার পথে রিকশা নিলাম । ভাবলাম রিকশাওয়ালা চাচাকে একটু সচেতন করি ।
“চাচা, করোনা আসছে বুঝছেন তো ? অন্য মানুষের চাইতে ৩ ফুট দূরত্বে থাকবেন, বুঝছেন ?”
চাচা বললো “মুরুক্ষু মানুষ ফুট-টুট তো বুঝিনা বাবা । কয়হাত সেইটা কন ।” আমি আবারও বোকা হয়ে গেলাম !
.
ভেবে দেখলাম । আসলেই তো । করোনা নিয়ে সচেতনার কম্যুনিকেশনে কত বড় একটা ফাঁক রয়ে গিয়েছ আমাদের দেশে !
.
যে কোন কম্যুনিকেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ব্যপার হচ্ছে – Clarity এবং Relevancy । Clarity অর্থাৎ, যাকে কথাটি বলা হচ্ছে তিনি বুঝতে পারছেন কি না এবং Relevancy হলো যা বলা হচ্ছে ব্যপারখানা তাঁর জন্য প্রাসঙ্গিক বা গুরুত্বপূর্ণ কি না ।
.
যদি Communication খানা Clear না থাকে, তবে যত টাকা খরচ করেই তা বানানো হোক কিংবা যত টাকা খরচ করেই তা প্রচার করা হোক তাতে কোনো লাভ নেই । ধরুন, আপনার সামনে সুইডিশ ভাষায় তৈরী একখানা রেডিও এ্যাড ছেড়ে দেয়া হলো, অথচ মজার ব্যপার হলো আপনি সুইডিশ ভাষা জানেন না । সুতরাং, এ্যাডে কি বলছে না বলছে তার বিন্দুমাত্র মাথামুন্ডুও আপনি বুঝতে পারছেন না । সুতরাং, সেই এ্যাডখানা যদি সুইডেনের শ্রেষ্ঠ কন্ঠশিল্পী দিয়েও করা হয়ে থাকে তাতেও কোনও লাভ নেই । আপনার কাছে সে সবই ‘অর্থহীন বকবক’ ছাড়া আর কিছুই নয় ।
.
আবার ধরুন আপনার বসবাস ঢাকায় । আপনাকে দেখানো হচ্ছে বাড়ির লনে তুষার পরলে সেটি পরিষ্কার করার যন্ত্রের এ্যাড । আপনি কি সেটি দেখতে আগ্রহী হবেন ? নিশ্চয়ই না । বরং বলবেন ধ্যুর ! এই জিনিষ দেখে আমার কি লাভ ? ঢাকায় বরফও পড়ে না, আর আমি থাকি ফ্ল্যাটে । এখানে লন আসবে কোত্থেকে ! এই ব্যাপারটা হচ্ছে Relevancy । আপনি যাকে গল্প বলছেন তার কাছে গল্পের প্রাসঙ্গিকতা না থাকলে যত সুন্দর করেই গল্পটা বলুন না কেন কোনও ফায়দা নেই । গ্রামে একটা প্রবাদ আছে “শীতকালে গরমের ওয়াজ করতে নেই ।” এই প্রবাদখানা আর কিছুই নয়, বরং কম্যুনিকেশনের Relevancy বা প্রাসঙ্গিকতা ।
.
যাক বলছিলাম করোনা সংক্রান্ত আমাদের Communication নিয়ে । এই কম্যুনিকেশনে সবচেয়ে বেশী যে শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে তা হলো ‘সামাজিক দূরত্ব’ এবং ‘X ফিট দূরত্ব’ । আচ্ছা, ‘সামাজিক দূরত্ব’ কথাটার মানে কয়জন আমরা বুঝি ? আপনার ড্রাইভার, বাসায় বুয়া, দারোয়ান, কেয়ার টেকার কিংবা বাসার কাপড় নিতে আসা লন্ড্রীর ছেলেটাকে একটু জিজ্ঞেস করে দেখুন তো । দেখুন উনারা বোঝেন কি না ! আমি মোটামুটি ৮০ শতাংশ নিশ্চিত যে তাঁরা বোঝেন না, কিংবা বুঝলেও ভাসাভাসা । অথচ, করোনা প্রতিরোধে আমরা “সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন” বলে বলে গলা ফাটাচ্ছি । আবার লোকে সেই কথা শুনছেন না বলে আফসোস, আহাজারী, মেজাজ খারাপও করছি । কিন্তু কি করে শুনবেন যদি কি বলছি সেটাই না বোঝেন !
.
আবার ‘X ফিট’ দূরত্ব । আমাদের দেশের বেশীরভাগ সাধারণ লোক এখনও হাত হিসেবে মাপ বোঝেন । তাঁদেরকে ফিট হিসেবে দূরত্ব নিশ্চিত করতে বলাটা অন্ধকে হাতি দেখাবার মতই আর কি । যার যেমন ইচ্ছে মেপে নিচ্ছেন । এখানেও সেই একই সমস্যা – কি বলছি সেটিই বোঝাতে পারছি না !
.
আর ‘কোয়ারান্টাইন (Quarantine)’ । থাক্ ! এটার কথা আর নাই বা বললাম । বলতে গেল আমার নিজেরই প্রায় দাঁত ভেংগে যায় । সেখানে এটার মানেটা কি সেটা বুঝতে যাকে বলে “হাতি-ঘোড়া গেল তল” ! অথচ, কোয়ারান্টাইনে থাকুন – কোয়ারাইন্টাইনে থাকুন বলে সমানে চ্যাঁচাচ্ছি । আমি নিশ্চিত জিগ্গেস করলে অনেক সাধারণ মানুষই বলবেন “আমার বাড়িতে তো কোয়ান্টা-ফোয়ান্টা নাই । তাইলে থাকব ক্যাম্নে ? সরকার দিলে না হইলে থাকা যাইত । “
.
কেন এই শব্দগুলো আমরা বলছি ? কারণ, যখন প্রথমে চীনে এবং পরে ইউরোপে করোনা আঘাত হানলো, তখন ওরা একটা টার্ম ব্যবহার করা শুরু করল – Social distance। এই টার্মটা ওদের জন্য বোঝা সহজ । ওরা ঠিকই জানে Social distancing বলতে কি বোঝানো হচ্ছে । সেখানে আমরা কি করলাম । চট করে ডিকশনারী দেখে সোজাসুজি এই টার্মটার একটা আক্ষরিক বাংলা তরজমা বের করে ফেললাম – ‘সামাজিক দূরত্ব’ । মনে করলাম ব্যস্ কাজ হয়ে গেছে ! এখন গলা ফাটিয়ে বলে গেলেই হবে । ভাই পড়ালেখা জানা সন্মানিত শিক্ষিত সমাজ, একবার কি চিন্তা করে দেখেছেন যে আপনার কাছে না হয় ডিকশনারীটা আছে, কিন্তু আপনার ড্রাইভার, কাজের বুয়া, সব্জীওয়ালা, দারোয়ান, পাড়ার দোকানদার, কেয়ারটেকারে কাছে কিন্তু ডিকশনারী নেই । সুতরাং, যেটি আপনি বুঝে ফেলেছেন (!), সেটি বাকি সবাইও পই পই করে বুঝে ফেলেছে সেটি আশা করাটা কি ঠিক হচ্ছে ? অথচ, এই কম্যুনিকেশনের পেছনে সরকারী ও বেসরকারী দু-পর্যায়েই খরচ করে ফেলেছি এবং এখনও খরচ করে চলেছি কোটি কোটি টাকা ! এতটাকা খরচ করছি অথচ কি বলছি সেটাই লোকে বুঝতে পারছে না শুধুমাত্র ঠিক মত ঠিক শব্দ ব্যবহার না করার কারণে ! কি নিদারুণ অপচয় !
.
অথচ, চাইলেই কিন্তু এই ভুলটা এড়ানো যেত । Communication টা তৈরী করার আগে শুধু ডিকশনারী কিংবা হালের গুগল ট্রান্সলেটর ব্যবহার না করে প্রফেশনালি যাঁরা কম্যুনিকেশন নিয়ে কাজ করেন – মার্কেটিং কিংবা কম্যুনিকেশন এজেন্সী, তাঁদের দিয়ে একটিবার ঝালাই করিয়ে নেয়াটা কি খুব অসম্ভব কিছু ছিল ? এমনকি আমার মাথাতেও এই দুটো শব্দের সহজ এবং সুবোধ্য বাংলা প্রতিশব্দ আছে । সেখানে যাঁরা জ্ঞানী, তাঁদের জন্য এটি বের করা কোন ব্যপারই ছিল না । দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘গণযোগাযোগ’ নামক একখানা সাবজেক্ট আছে এবং সেখান থেকে গত কয়েক দশকে লাখ লাখ গ্রাজুয়েট বের হয়েছেন । তাঁদের একজনও খেয়াল করলেন না গনযোগাযোগের এই sensitive ব্যপারখানা ? বিসিএস পাশ করা বিশাল বিশাল শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী যাঁরা সরকারী বিভিন্ন বিভাগ চালাচ্ছেন, যাঁদেরকে প্রাত:স্বরণীয় এবং সবচেয়ে মেধাবী-তুখোর মানুষ বলেই আমরা এবং আমাদের মামা-খালা, চাচা-চাচীরা সহ যাবতীয় মুরুব্বীরাও জানেন, তাঁরাও কেউ এই বিশাল ব্যপারটা ধরলে পারলেন না ?!? অথচ, টাকার শ্রাদ্ধ করে রীতিমত গলা ফাটিয়ে চলছি ।
.
এই ঘটনা থেকে আমাদের, মানে মার্কেটিয়ারদের কিন্তু একখানা জিনিষ শেখার আছে । সেটি হলো Communication জিনিষটি যত সহজ বলে মনে হয়, আদতে মোটেও তত সহজ নয় । তাই Communication তৈরীর সময় বারবার খেয়াল করে উচিৎ, চেক করা উচিৎ। প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা ধ্বনি, প্রতিটা ছবি, প্রতিটা মিউজিক দর্শক-শ্রোতার মনে ভিন্ন ভিন্ন মানে তৈরী করে । কনজ্যুমারকে এই শব্দ-ধ্বনি-ছবি-মিউজিক কি মেসেজ দিচ্ছে সেটি বোঝাটা, সেই মেজেকটি আমার ব্র্যান্ডের কম্যুনিকেশন অবজেকটিভের সাথে যাচ্ছে কিনা, সেটা জেনে-বুঝে সেই মতো কম্যুনিকেশন ডেভেলপ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । করার পর Airing এর আগে সেটিকে Test করাটাও জরুরী । হয়ত তাতে একটু সময় বেশী লাগবে কিংবা কিছু টাকা বেশী খরচ হবে তবে সেটি এয়ারিং খরচের তুলনায় কিছুই না । আবার Airing শুরু করার কয়েকসপ্তাহ পরে একটা ছোটখাট Post-Evaluationও করা যায় – এটি বোঝার জন্য যে মাস অডিয়েন্স ঠিক মেসেজটি পাচ্ছে কি না ।
.
অনেকেই এগুলো করেন । আবার অনেকেই আমরা শুধু ব্র্যান্ড ডিরেক্টর, ম্যানেজমেন্ট কিংবা মালিক পছন্দ করেছেন বলে খুশী হয়ে কম্যুনিকেশন ছেড়ে দেই । ভাই, কম্যুনিকেশনটা তো ব্র্যান্ড ডিরেক্টর, ম্যানেজমেন্ট কিংবা মালিকের জন্য নয়, বরং আপনার Consumers দের জন্য । আর আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিসটাও কিন্তু শুধু ব্র্যান্ড ডিরেক্টর, ম্যানেজমেন্ট কিংবা মালিক কিনলে আপনার Business Case viable হবে না; বরং কিনতে হবে সেই কনজ্যুমারদেরই । সুতরাং, তাঁরা বুঝলেন কি না, তাদের জন্য কনভিন্সিং হলো কি না, সেটি জানা এবং বোঝাটাই কি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার না ? সেটি না করার কারণে কম্যুনিকেশন যদি ফেইল করে তখন কিন্তু মার্কেটিয়ার হিসেবে আপনার গলাটাই লাইনে আগে আসবে । ম্যানেজমেন্ট কিংবা মালিক কেউ তখন আপনার সাধের গলা, মানে চাকরীখানা, রক্ষা করবেন না ।
.
তাই কম্যুনিকেশনের ডিরেক্টর কে, কোন কোন স্টার অভিনয় করল কিংবা থাইল্যান্ড কিংবা মুম্বাই কোথায় শুটিং হলো… … … কিচ্ছু লাভ নেই । একই ভাবে সেটিকে সবচেয়ে ভাল প্রাইম স্পটে অসংখ্যবার দেখিয়েও লাভ নেই । তাই বরং মাথায় রাখি সবচেয়ে জরুরী কিছু পয়েন্টস – কম্যুনিউকেশনে ‘কি বলছি’, ‘কিভাবে বলছি’ এবং ‘যার জন্য বলছি তিনি বুঝছেন কি না’ ।