Written by 4:51 pm Brand Practitioners

সংকটে-মার্কেটিং-৪ অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান

Screenshot 2
Walton and Herlan Ads

লেখকঃ অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

করোনার প্রতিঘাতে বদলে যবে ব্যবসায়ের ধরন। অন্তত এখন যেভাবে চলছে সেভাবে আর চলবে না। ‘নিউ নর্মাল’ যতক্ষণ না ‘রেগুলার নরমালে’ পরিবর্তন হবে ততক্ষণ স্বল্পমেয়াদী বড়জোর মধ্যমেয়াদী ব্যবসায় পরিকল্পনাকেই বেশি জোর দিতে হবে। অবশ্যই চলতি প্রবণতাগুলোর মধ্যে যেগুলো স্থিতু হবে সেগুলো পূর্বানুমান করে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার এখনই ছক তৈরি করতে হবে। গত কয়েক মাসে অনেক কিছুই বদলে গেছে।

ভোক্তারা অনেকেই আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেছে। ভোক্তার আচরণ বদলে যাচ্ছে। ভোক্তারা কোথায় কীভাবে কত টাকা খরচ করবে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে। ভোক্তার মনোজগৎ যে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে তাঁর শোনার ও দেখার আগ্রহ পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিযোগিতার পরিবেশ বদলে যাচ্ছে। নতুন এক বাস্তবতার দিকে ঝুকছে ক্রেতা।

বর্তমান সময়টাই হচ্ছে ক্রেতার নিকট ব্যাবসায়ের ‘অর্পণ’ কে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরার মোক্ষম সময়। কোম্পানিকে তার অর্পণকে ভোক্তার সমস্যার ”সমাধান” হিসেবে তুলে ধরতে পারলে সুবিধাবাদীতা (opportunism) অপেক্ষা পরার্থবাদীতা (alterism) ভাবমূর্তি তৈরি সম্ভব হবে। কোম্পানি সংকটকালে কোন অন্যায় সুযোগ নিচ্ছে না বরং ক্রেতার সমস্যা সমাধানে কাজ করছে এটা কোম্পানির ইমেজ তৈরিতে বড় ধরণের ভূমিকা রাখবে। কোম্পানির পণ্যটি কার জন্য এটা নির্দিষ্ট করতে হবে। কোম্পানি কি তার টার্গেট পরিবর্তন করছে? অর্পণটির অন্তর্নিহিত সুবিধাটা কি? সংকটকালে কোম্পানির অর্পণের সুবিধাগুলো কি ক্রেতার নিকট গুরুত্বপূর্ণ? ক্রেতার সংকটকালীন কোন্ কোন্ নীডটিকে কোম্পানির অবস্থান গ্রহণের (positioning) হাতিয়ার হিসেবে নিচ্ছে সেটা সুনির্দিষ্ট করতে হবে। অস্থিরতার সময় মানুষ নীড মৌলিকতার দিকে ধাবিত হয়। বাহুল্যের প্রতি আকর্ষণ কমে যায়। মন্দার সময় অনুগত ক্রেতাদেরকেই বেশি করে স্মরণ করতে হবে। তাদের ধরে রাখতে পারলেই কোম্পানির নগদ প্রবাহ অব্যাহত থাকবে। সকল ক্রেতা একই গুরুত্ব বহন করে না। প্রকৃতপক্ষে বাজারজাতকরণ হচ্ছে লাভজনক ক্রেতা আকর্ষণ করা ও ধরে রাখার কলা। সাধারণ ক্রেতার জন্য কোম্পানি যা খরচ করে তা উঠে আসে কোম্পানির সর্বোত্তম ক্রেতাদের কাছ থেকে। আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী James V. Putten এর মতে সাধারণ ও সর্বোত্তম ক্রেতার অনুপাত খুচরা ব্যবসায় ১৬:১, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ১৩:১, এয়ারলাইন্সের ব্যবসায় ১২:১, হোটেল মোটেল শিল্প ৫:১। তারপরও কিছু ক্রেতার নিকট পণ্য বিক্রয় করে কোম্পানি লোকসান দিতেই হয়। সুপরিচিত “২০-৮০” নীতিতে বলা হয় কোম্পানির ৮০% মুনাফা আসে ২০% ক্রেতার নিকট থেকে। Sherden এই নীতিটা কিছুটা পরিবর্তন করে বলেছেন “২০-৮০-৩০” নীতির কথা। এই নীতিতে বলা হয় ৮০% মুনাফা আসে ২০% ক্রেতার নিকট থেকে তবে মুনাফার অর্ধেক নষ্ট হয়ে যায় নীচের দিকের ৩০% অলাভজনক ক্রেতার সেবা দিতে। এর অর্থ হচ্ছে সবচেয়ে অলাভজনক ক্রেতাদের তাড়িয়ে দিয়ে কোম্পানি তার মুনাফা বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়াও আরো দুটি বিকল্প করণীয় আছে: মূল্য বাড়ানো অথবা অলাভজনক সেবার খরচ কমানো,যা আমরা ইতিপূর্বেই (সংকটে মার্কেটিং-৩) আলোচনা করেছি। কিছু ক্রেতা থাকে যারা খুবই অনুগত কিন্তু অলাভজনক। মফস্বল শহরে অথবা গ্রামে হেটে এদের বেশি দেখা যায় চায়ের দোকানে সকালে বসে বিকেল পর্যন্ত, বিকেলে বসে গভীর রাত পর্যন্ত থাকে। বন্ধের দিন আড্ডা দেয়, অন্য কোন দোকানে যায় না। অন্য দোকানের খাবারও খায় না। এই দোকানেই বসে থাকে। দিনশেষে কেবলমাত্র চা আর সিঙ্গারা বাবত বিল আসে মাত্র ৩০ টাকা। এ ধরণের অনুগত ক্রেতার জন্য ভালো ক্রেতারাও চা দোকানে বা রেস্টুরেন্টে বসার সুযোগ পায় না। এরা দোকানে বসে থাকার কারণে ব্যবসায়ে ক্ষতি হয় বেশি। এ ধরনের অনুগত ক্রেতাদের যত দ্রুত বিদায় করা যাবে ততই মঙ্গল। সম্ভব হলে তাদেরকে প্রতিযোগীর পাশের রেস্টুরেন্টে পাঠানো যেতে পারে। সবচেয়ে বড় ক্রেতার নিকট থেকেই সবচেয়ে বেশি মুনাফা আসবে এটা নাও হতে পারে। বড় ক্রেতারা বেশি সেবা ও সর্বোচ্চ আর্থিক সুবিধা দাবি করে। ক্ষুদ্র ক্রেতারা পুরো দাম দিয়েও সর্বনিম্ন সেবা পায়,কিন্তু তাদের সাথে লেনদেনের খরচ বেশি হওয়ায় মুনাফার যোগ্যতা কমে যায়। মধ্যম আয়তনের ক্রেতারা ভালো সেবা পায়,পুরো দাম দেয় এবং প্রায়ই এরা সবচেয়ে লাভজনক ক্রেতা। এই সংকটের সময়ে নতুন বড় ক্রেতা ধরার জন্য ব্যস্ত না হয়ে মাঝারি সাইজের ক্রেতাদের দিকে নজর দিতে হবে।

অর্থনৈতিক সংকটের সময় বাজারজাতকরণ চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বাজারজাতকরণ কোন ঐচ্ছিক বিষয় না। প্রধান ক্রেতা এবং অন্যান্যদের নিকট থেকে কোম্পানির জন্য আয় নিয়ে আসার এটি একটি আবশ্যকীয় “ভালো খরচ”(good cost)। এসময়ে ক্রেতাদের সাথে কথা বলার সময় কৌশলী হতে হবে। অস্থিরতার সময় ক্রেতার মনোভাবকে যারা সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে পারবে তারাই সফল হবে। ক্রেতারা সাশ্রয়ী হওয়ার প্রয়োজনে বিকল্প মূল্যায়নের জন্য বেশি সময় নিবে। সহজে প্ররোচিত হবে না। লোভনীয় অর্পণের বিপরীতে তাদের সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরবে। অর্পণের মধ্যে আর ‘কি সুযোগ আছে’ তা খতিয়ে দেখে প্রতিযোগী কোম্পানির অর্পণের সাথে তুলনা করতে সময় নিবে। উপস্থাপিত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইবে। তারা সঠিক পণ্য বা সেবাটিই পছন্দ করছে এ ব্যাপারে অধিকতর নিশ্চয়তা চাইবে। বিক্রেতাকে ক্রেতার প্রতি আরো বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। এ সময়ে টানাটানিতে থাকা ক্রেতারা তাদের ভোগের তালিকা কাটছাঁট করবে। পরিবর্তিত অবস্থাতেও বিক্রেতার পণ্য বা সেবাটি কেন ক্রেতার কাটছাঁট করা তালিকায়ও স্থান পেতে পারে তা পরিষ্কার করে ক্রেতার সামনে তুলে ধরতে হবে।

ব্র্যান্ডের ক্ষয়ক্ষতি এখনো অজানা। ছোট এবং মাঝারি সেক্টর (SME) -এর ব্যাবসায় পড়তি ডাবল ডিজিট অতিক্রম করেছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। যারা এ সংখ্যায় যুক্ত হতে চাইবে না তাদের মার্কেটিং কার্যক্রম জোরালো করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। ঘরবন্দী ক্রেতারা তাদের নীডের প্রতি সংবেদনশীল বার্তার প্রতি অধিক মনযোগী হয়।

বেকারত্ব ও অন্যান্য কারণে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় “অল্প টাকার” জন্যও বিক্রেতাদের মধ্যে টানাটানি শুরু হবে। ক্রেতারা ডিজিটাল স্ক্রিনে এখন বেশি চোখ রাখে। ডিজিটাল মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। বিনোদনের অংশ হিসেবে কোম্পানিকে তার পণ্যের পারফরম্যান্স তুলে ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে দুর্যোগের সময় ব্র্যান্ডের চেয়ে ক্রেতারা পারফরম্যান্সের প্রতি বেশি সংবেদনশীল হয়। যারা বিজ্ঞাপন তৈরি করবে তাদের মনে রাখতে হবে এ সময়ে জনগণ আতঙ্কের মধ্যে থাকে। বিজ্ঞাপন নির্মাতাকে বুঝতে হবে কাদের উদ্দেশ্যে তাঁর বার্তা এবং কোন বিষয়টাকে জোর দিতে হবে, কারণ ইতোমধ্যেই অডিয়েন্সের নীড পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে অডিয়েন্সের সবচেয়ে অগ্রাধিকারের বিষয় হচ্ছে তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা। বাকি সবকিছু এখন পিছনে পড়ে গেছে। পণ্য বিক্রির জন্য করোনা-উত্তর কালে অনেক সময় পাওয়া যাবে। এসময়ে ক্রেতার বিপদে সহমর্মিতা প্রকাশ হবে যথাযথ অ্যাপ্রোচ। এ সময়ে ক্রেতারা আর্থিক সংকটে থাকে বিধায় অর্পণের আর্থিক প্রণোদনা ও সুবিধার প্রতি বেশি মনযোগী হয়। বিক্রেতাকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী স্টেকহোল্ডারদের জন্য কিছু করতে হবে। সকল ব্যাবসায়ী মন্দায় আক্রান্ত। ফুটপাতের চা দোকান থেকে এয়ারলাইনস পর্যন্ত প্রত্যেকেই তাদের মত করে সাঁতার কাটছে। তারপরও স্টেকহোল্ডারদের সাহায্য করার জন্য কোম্পানিগুলো কিছু না কিছু করছে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন না থাকলেও কর্মী ছাঁটাই করছে না। সব কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছে, সযত্নে ছুটি দিচ্ছে। অবশ্য কিছু কিছু ব্যতিক্রমও আছে। কোন কোন কোম্পানি তার কর্মীদেরকে কোন আর্থিক সুবিধা ছাড়াই বিদায় করে দিচ্ছে। অনেক কোম্পানি ত্রাণ ও স্বাস্থ্য সামগ্রী বিতরণ করছে। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা কোম্পানির ইমেজ বাড়াতে পুঁজি হিসেবে স্টেকহোল্ডারদের মনে সঞ্চিত হচ্ছে যা সুদিনে ভালো রিটার্ন দিবে।

ক্রেতারা মৌলিক পণ্যের প্রতি মনযোগী হবে। মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি রপ্ত করেছে। এটা বজায় রাখার জন্য উপযোগী অর্পণ নিয়ে যারা এগিয়ে আসবে তারা ভাল ব্যাবসায় করতে পারবে। রোগ সংক্রমণের ভীতি দূর করার দায়িত্ব ব্যাবসায়ীকে নিতে হবে। অনলাইন চ্যানেল খোলাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ব্র্যান্ডকে রিপজিশনিং এর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে ব্র্যান্ড ইমেজ পরিবর্তনেরও চেষ্টা করতে হবে এবং নতুন অবস্থানটি ক্রেতাদের সুনির্দিষ্ট করে জানিয়ে দিতে হবে।

ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সুপারিশ হচ্ছে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া অলাভজনক ব্যবসায় ছারার এটাই সময়। এলাকার মানুষের চাহিদার পরিবর্তনটি ভালোভাবে অনুধাবন করে ব্যবসায় পরিবর্তন করতে হবে। একসময় সিনেমা হলগুলো “হাউসফুল” থাকতো। আমার মনে আছে স্বাধীনতার পরপর কুমিল্লার একটি সিনেমা হলে ‘সুয়োরাণী দুয়োরাণী’ সিনেমা দেখার জন্য দুই টাকার টিকেট ২০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছিল। উল্লেখ্য, আমাদের আমলে সিনেমাগুলোর নাম এমনই ছিল যেমন- বেহুলা সুন্দরী, রাজা সন্ন্যাসী, কাঞ্চনমালা ইত্যাদি। আজকের দিনে সিনেমার যে ধরনের নামকরণ করা হয় তা তখনও চালু হয়নি। ইদানীংকালে সিনেমার নাম দেখছি- ধর শালারে, পালাবি কোথায়, স্বামী কেন পলাতক, বাবা কেন আসামি ইত্যাদি। বেশিদিন সময় লাগেনি, সিনেমার বাজারে এমন পতন আসে বেশিরভাগ সিনেমা হল ভেঙে নতুন মার্কেট করা হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার স্বাস্থ্য বিধান পালন করতে গিয়ে ওই আধুনিক মার্কেটেও ক্রেতা পাওয়া যাবে না। ওই মার্কেটগুলো ভেঙে বা সংস্কার করে ছোট ছোট এক কামরার বাসযোগ্য অ্যাপার্টমেন্ট হয়তো তৈরি করতে হবে। মধ্যমা বা স্বল্প বেতনের/ আয়ের একা থাকা লোকেরা যারা কয়েকজন মিলে, কখনো কখনো ১০/১৫ জন একসাথে, গাদাগাদি করে মেসে থাকে তাঁরা অন্য ব্যয় কমিয়ে হলেও এখন প্রত্যেকে আলাদা থাকতে চাইবে। এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টগুলো দ্রুতই ভাড়া দেওয়া যাবে বা বিক্রি করা যাবে। কারণ আইসোলেশন বা একা থাকার ব্যাপারটি আমাদের সংস্কৃতিতে আস্তে আস্তে সুদৃঢ় হবে।

মার্কেট নীচার’রা (nichers) বিশেষীকরণের উপর টিকে থাকে। কথায় আছে,”Key to nichemanship is specialisation”। একটা বিশেষায়িত সেবার চাহিদা কমে গেলে নতুন একটি বিশেষায়িত সেবার চাহিদা বেড়ে যায়। ছোট উদ্যোক্তাদের এই সুযোগটা নিতে হবে। অলাভজনক এবং ভবিষ্যৎ অন্ধকার যে ব্যবসার সেটাকে আঁকড়ে ধরে কান্নাকাটি না করে দ্রুত বিসর্জন দেওয়াই ভালো।

Share this on
Close