করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৩৫টি জেলায় মানুষকে সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছে ব্র্যাক। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলা নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সহযোগিতা করছেন। করোনা সংক্রমণ মোকাবেলায় এই প্রথম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে একযোগে এত বিস্তৃত এলাকায় কাজ শুরু হচ্ছে। উদ্যোগের শুরুতেই জেলাগুলোতে মোট ১ কোটি ৩০ লাখ মাস্ক বিতরণ শুরু হচ্ছে । এই কর্মসূচীর মূল অর্থায়ন আসছে গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা’র অনুদান ও ব্র্যাক-এর নিজস্ব তহবিল থেকে। এছাড়াও বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থা এর সাথে যুক্ত হচ্ছেন, যাদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া সরকার অন্যতম।
কমিউনিটিকে সংযুক্তিকরণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা খাতকে শক্তিশালী করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশানগুলোর সম্মিলিত মঞ্চ সিএসও অ্যালায়েন্স এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে নিয়ে কাজ শুরু করেছে তারা।
নির্বাচিত জেলাসমূহে ৪১ টি স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এই উদ্যোগে সহযোগী হিসাবে অংশ নিচ্ছে। আজ মঙ্গলবার (১লা জুন) সকালে এক ডিজিটাল প্রেস কনফারেন্সে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ এই ঘোষণা দেন।
এ উদ্যোগের মাধ্যমে ওই ৩৫ জেলায় কাজ করবেন ব্র্যাকের ২৭ হাজার ৫০০ কর্মী। সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হবে মাস্ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে। তা ছাড়া করোনা প্রতিরোধে নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় যথাযথ সতর্কতা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রচারণা এবং ভ্যাকসিন রেজিস্ট্রেশনের পাশাপাশি সচেতনতামূলক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ভুল তথ্য ও গুজব নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলো হলঃ ময়মনসিংহ, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ, ঢাকা, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, খুলনা, মাগুরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, সিলেট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাট, নাটোর, ভোলা, বরিশাল, দিনাজপুর, রংপুর, লালমনিরহাট, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী এবং চাঁদপুর। ব্র্যাকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরে এই উদ্যোগ প্রয়োজনের নিরিখে পর্যায়ক্রমে সারা দেশে চালু করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কেএএম মোর্শেদের সঞ্চালনায় এই ডিজিটাল প্রেস কনফারেন্সে আরও উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক মুশফিক মোবারক, ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির পরিচালক ডাঃ মোর্শেদা চৌধুরী অনুষ্ঠানে এই উদ্যোগের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার বেড়ে চলায় কেন্দ্রীয়ভাবে মোকাবেলার পাশাপাশি কমিউনিটি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যেই এই সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালগুলি রীতিমতো চাপে রয়েছে। অন্যদিকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় অনেকেই অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে আচরণগত পরিবর্তন এবং কমিউনিটিকে এই প্রক্রিয়ায় জড়িত করার কোনো বিকল্প নেই।
এই উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদানকালে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, “করোনা প্রতিরোধে সামাজিক দূর্গ গড়তে চাই সমাজের সকল স্তরের মানুষের সংযোগ ও সদিচ্ছা, বিশেষত স্থানীয় পর্যায়ের মানুষের নেতৃত্ব। দেশের সব মানুষ করোনা টিকার অধীনে না আসা পর্যন্ত, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। আমরা আমাদের সর্বশক্তি নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ছি, পাশে পেয়েছি ৪১ টি সহযোগী উন্নয়ন সংস্থাকে। আশা করি বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রিয় ওপিনিয়ন লিডার অর্থাৎ যাদের কথা মানুষ শোনেন, তারা আমাদের উদ্যোগের সাথে যুক্ত হবেন ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আচরণে পরিবর্তন আনতে আমাদের সহযোগিতা করবেন।”
ইয়েল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মুশফিক মোবারক বলেন, “এ দেশে বিশেষ করে জনসমাগমের স্থানগুলোতে মাস্কের ব্যবহার খুবই কম দেখা যায়। ইয়েল ও স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে আমরা বাংলাদেশের ৬০০ ইউনিয়নে একটি গবেষণা করেছি। তাতে দেখা গেছে, অনেকে মাস্কের প্রয়োজনীয়তা বোঝে না, অনেকে আবার খরচের কথা ভেবে মাস্ক পরে না। আমরা গবেষণাতে আরও পেয়েছি যে তিন স্তরের পুণর্ব্যবহারযোগ্য সার্জিক্যাল মাস্ক কম খরচে এই দেশেই উৎপাদন সম্ভব। সারা দেশে বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র, বিশাল কর্মীবাহিনী থাকায় ব্র্যাক এই উদ্যোগে সফল হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।”
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, “মহামারির এই ক্রান্তিকালে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই ব্র্যাকের সঙ্গে আমরা আরও ৪১ টি উন্নয়ন সংস্থা এই উদ্যোগে যোগ দিয়েছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য, জনসাধারণকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝিয়ে তাদের দায়বদ্ধতাকে বাড়িয়ে দেওয়া। সমাজের ঘরে ঘরে সচেতনতা আনতে পারলেই এই সংকট মোকাবেলা সহজ হয়ে যাবে।”
এর আগে, ব্র্যাক গত ৫ মাস করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যুক্তরাজ্য সরকারের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও)-এর সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৬টি জেলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস) এবং কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি পাইলটিং কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এই পাইলট প্রকল্পের সাফল্যের উপর ভিত্তি করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) শনাক্তকৃত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলায় সংক্রমণ কমাতে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করবে ব্র্যাক। উদ্যোগটি পরিচালিত হবে ৩টি মূল স্তম্ভের মাধ্যমে- প্রতিরোধ, করোনাভাইরাস কেস ব্যবস্থাপনায় রেসপন্স এবং করোনা টিকার প্রচার।
প্রতিরোধ: ব্র্যাকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মাস্ক এর কম ব্যবহার সরাসরিভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই প্রথম পর্যায়েই আচরণগত পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ঘরে ঘরে সচেতনতামূলক বার্তার মাধ্যমে মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোয়ার চর্চা, এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা নিশ্চিত করা হবে। এখানে কাজ করবে বিভিন্ন সামাজিক সহায়তা দল। এছাড়াও করোনার হটস্পটগুলো যেমন- মসজিদ, পরিবহন কেন্দ্র, বাজার এবং দোকানে প্রতিরোধমূলক আচরণ নিশ্চিতকরণে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা, স্বেচ্ছাসেবক এবং সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি তৈরি করা হবে। স্বাস্থ্যকর্মী এবং বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সঠিক বার্তা প্রদান করে মানুষকে সচেতন করা হবে। সময়ে সময়ে এই কার্যক্রমের ফলাফল মূল্যায়ন করা হবে।
কেস ব্যবস্থাপনায় রেসপন্স: এ পর্যায়ে ফ্রন্টলাইন কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের নেতৃত্বে ঘরে ঘরে লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিদের উপর নজরদারি বাড়ানো হবে। এ কাজে ব্র্যাকের প্রমাণিত সামাজিক সহায়তা দল মডেলটিকে এই উদ্যোগের অধীনে আরো প্রসারিত করা হবে। এই কমিউনিটি সহায়তা টিমগুলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবারগুলোর সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে পরিবারে লক্ষণযুক্ত ব্যক্তি শনাক্তকরণের চেষ্টা করবেন যাতে করে তাদের স্ক্রিনিং করানো যায়। ক্লিনিক্যাল মিল পাওয়া গেলেই লক্ষণ হিসেবে ধরে, তাদেরকে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে টেলিমেডিসিন সহায়তা দেওয়া হবে। এছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে হালকা বা মাঝারি লক্ষণযুক্ত ব্যাক্তিদের ঘরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, সম্ভাব্য রেফারাল পয়েন্ট এবং টেস্টিং কেন্দ্রের ঠিকানা, কোয়ারেন্টাইন প্রটোকল এবং সর্বোত্তম চর্চাগুলো নিয়ে তথ্য প্রদান করা হবে। কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতে নিয়মিত ফলো-আপও করা হবে।
টিকার প্রচার: করোনাভাইরাস টিকা নিবন্ধন এবং মোবিলাইজেশন নিয়ে স্থানীয় সরকারের অধীনস্থ স্বাস্থ্য অফিসগুলোকে ব্র্যাক এবং অংশীদার প্রতিষ্ঠানসমূহ সহায়তা করবে। গুজবের কারণে টিকা গ্রহণ নিয়ে কমিউনিটি পর্যায়ে সংশয় রোধে এছাড়াও উক্ত জেলাগুলোতে টিকাদান কার্যক্রমের প্রচারের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে মাইকিং এবং জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল, রেডিও, পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন বার্তা প্রচার করা হবে।