বিজ্ঞাপন তৈরি নিয়ে বর্তমানে আমাদের দেশের কোম্পানি গুলোর মার্কেটিং টিম এবং এজেন্সি গুলোর ক্রিয়েটিভরা যে পরিমাণ স্ট্রাগল করছেন বা এফোর্ট দিচ্ছেন, এর বিপরীতে মার্কেট/কাস্টমার সাইড থেকে কতটা ফলপ্রসূ রেসপন্স আসছে তা নিয়ে যথেষ্ট হিসাব-নিকাশ ব্রান্ড প্রাকটিশনারসরা প্রতিনিয়ত করছেন। কারণ, আমাদের দেশের কাস্টমার/দর্শকদের বিজ্ঞাপন দেখানোটাই এই মূহুর্তে কোম্পানিগুলোর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, যেখানে পজিটিভ মার্কেট রেসপন্স পাওয়া তো অনেক পরের ইস্যু। অবশ্য এর পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে যা বিগত একটা পোস্টে বলেছিলাম। এবং আমাদের দেশের মার্কেটিয়ারদের এখন আরেকটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যে দর্শক ইউটিউব/অনলাইন কন্টেন্টের মাঝে নতুন পণ্যের বিজ্ঞাপন দিলে কোম্পানিকে গালাগাল করে, কিন্তু ঠিকই তারা অবসর সময়ে বসে ৯০’এর দিকের পুরানো বিজ্ঞাপন ইউটিউবে রীতিমতো সার্চ দিয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছে। সেসব বিজ্ঞাপনের মধ্যে এমনও বিজ্ঞাপন তারা দেখছে মার্কেটে যেসব পণ্যের কোন অস্তিত্বই এখন নাই!
মানুষের সাইকোলজি বড় অদ্ভুত জিনিস। খোদ ফিলিপ কটলার সাহেবই কনজ্যুমার সাইকোলজিকে একটা ‘ব্ল্যাক বক্স’এর সাথে তুলনা করেছেন। এবং পুরানো বিজ্ঞাপন দেখতে মানুষের যে আগ্রহ, সেখানে যতটা না লাভ-ক্ষতির হিসেব থাকে তারচে অনেক অনেক বেশি থাকে তাদের খুব ক্লোজ একটা সাইকোলজিক্যাল/ইমোশনাল এটাচমেন্ট।
আমরা যারা টুকটাক ব্যবসাপাতি বা অর্থনীতি নিয়ে নাড়াচাড়া করি, ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ নামে একটা টার্মের সাথে তারা পরিচিত। আমরা এটাও জানি যে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধাটা খুব ভালো ভাবে নিচ্ছে। আপনি এখন বলতে পারেন যে, ‘রাকিব সাহেব, পুরাতন বিজ্ঞাপন দেখার সাথে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের কী সম্পর্ক?’
দেখেন, একটা দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের চূড়ায় থাকা মানে, সেখানে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা বেশি। উল্টো দিকে চিন্তা করলে যারা এখন যুবক/কর্মক্ষম, ৯০’এর দিকে তারা পার করেছেন তাদের শৈশব, কৈশোর। সেটা ছিলো একটা নির্ঝঞ্ঝাট, নিরাপদ সময় যখন কোন দায়িত্ববোধ তাদের মাথায় চেপে বসেনি। এবং এটা মানুষের একটা কমন সাইকোলজিক্যাল ট্রেইট, তারা ভালো সময় গুলো বারবার ফিল/অনুভব করতে চায়। ৯০’এর দিকের পুরনো বিজ্ঞাপন গুলো তাদের কিছুটা সেই ভালো লাগার ফিল দেয়, অল্প সময়ের জন্য তারা সেই কিশোর বয়সের নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে ফিরে যায়। খেয়াল করলে দেখবেন, আমরা যেমন প্রিন্স মাহমুদের গান বা পুরনো বিজ্ঞাপনে আমাদের ভালো সময়কে খুঁজি, আমাদের বাবা-মায়েরা রাজ্জাক-কবরি/উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা বারবার দেখতে চান। কারণ সেই একই, সাদাকালো সিনেমার যুগে আমাদের বাবা-মায়েরা তাঁদের কৈশোর, যৌবনের সুন্দর সময়টা কাটিয়েছেন এবং তাঁরা তাদের সেই সময়টা ফিল করতে চান সাদাকালো সিনেমার মাধ্যমে।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক কতটা চ্যালেঞ্জ নিতে পারে। একজন মানুষ তার কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক, অর্থনৈতিক নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবার পরে তার মস্তিষ্ক একটা স্পেস চায়। তখন পছন্দের পুরনো নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন তাকে সেই স্পেসটা দেয়। বারবার, একটা সিনেমা/বিজ্ঞাপন দেখার পরেও তিনি ক্লান্ত হন না, কারণ সেই বিজ্ঞাপন/ সিনেমার সিকোয়েন্স আগে থেকেই তার মস্তিষ্কে গেঁথে আছে এবং নতুন করে মস্তিষ্ককের পরিশ্রম করতে হচ্ছে না। যা তাকে একটা ফিজিক্যাল ও সাইকোলজিক্যাল কম্ফোর্ট দেয়। ব্যাপারটা শুধু বিজ্ঞাপন/সিনেমার ক্ষেত্রেই খাটে না, বরং মিউজিকের ক্ষেত্রেও খাটে। আপনি যতটা আনন্দের সাথে জেমসের পুরনো গানগুলো শোনেন, তাঁর নতুন গানগুলো কিন্তু সেভাবে আপনি শোনেন না। ব্যক্তিগত ভাবে আমার কথাই যদি বলি, থ্রি ইডিয়টস সিনেমাটা এখন পর্যন্ত আমি ১০ বারের বেশি দেখেছি।
তাছাড়া এখনো এটা প্রশ্ন করার মতো ব্যাপার যে, আমাদের দর্শক/কাস্টমাররা কতটুকু ক্রিয়েটিভ? অথবা পরিবর্তন তারা কতটুকু নিতে পারে? লক্ষ্য করলে দেখবেন ৯০’এর দশক থেকে শুরু করে ২০০৫/০৬ সাল পর্যন্ত আমাদের বিজ্ঞাপন গুলো ছিলো মূলত জিঙ্গেল/ছন্দ বিশিষ্ট ট্যাগলাইন বেজড। তখন গরু মার্কা ঢেউটিন, রক্সি পেইন্ট, স্টার শিপ কন্ডেসড মিল্ক, নন্দিনী প্রিন্ট শাড়ি, অলিম্পিক ব্যাটারি, বাংলালিংক দেশ সিরিজ, মজো, চেজারের জিঙ্গেল গুলো ছিলো তুমুল জনপ্রিয়। আর, ‘মাছের রাজা ইলিশ, বাত্তির রাজা ফিলিপস’এর সাফল্য তো ব্রান্ডটা দীর্ঘদিন উপভোগ করেছে। এরপর জিঙ্গেল বদল হয়ে ধীরে ধীরে সেখানে স্টোরি বেজড বিজ্ঞাপন দেখানোর প্রবণতা বাড়তে লাগলো। কিন্তু কথা হচ্ছে আমাদের কাস্টমাররা কি এই পরিবর্তন কতটুকু নিতে পারছে বা তাদের সাইকোলজিতে আদৌ খুব বেশি পরিবর্তন এসেছে কিনা! আপনারা কি বলবেন জানিনা, তবে আমার ক্ষুদ্র পড়াশোনা থেকে মনে হয় আমাদের দর্শকদের সাইকোলজিতে তেমন আহামরি পরিবর্তন আসে নাই। খেয়াল করলে দেখবেন দেশে শিক্ষিতের হার বাড়লেও, ক্রিয়েটিভ লোকজনের সংখ্যা সে হারে বাড়ে নাই। আমাদের হল গুলোয় তৌকির আহমেদের হালদা মুভি ফ্লপ খায়, কিন্তু পুরনো ফর্মুলার শাকিব খানের সিনেমা ধুন্দুমার ব্যবসা করে। এই দিক থেকে চিন্তা করলে এখনো দর্শকরা জিঙ্গেল/মিউজিক বেজড বিজ্ঞাপনই বেশি পছন্দ করে। গেল কয় বছরে ঈদ মৌসুমে গ্রামীণফোনের ‘স্বপ্ন বাড়ি যাবে’ এর একটা উদাহরণ হতে পারে। সম্প্রতি ইভ্যালির বিজ্ঞাপনটাও ছিলো জিঙ্গেল বেজড এবং তাদের ‘Believe in you’ ট্যাগলাইনটা এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে একরকম ভাইরাল হয়ে যায়। হালের কাকলী ফার্নিচারের কথা নাহয় বাদই দিলাম। এবং, দর্শকদের পুরনো বিজ্ঞাপন দেখার পেছনে তাদের এই জিঙ্গেল/ছন্দ বিশিষ্ট ট্যাগলাইন শোনার প্রবণতা একটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
সরল কথায় বললে, যেহেতু বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য হচ্ছে কনজ্যুমারদের পকেট থেকে টাকা বের করা, তাই তাদের সাইকোলজি অনুযায়ী বিজ্ঞাপন বানানোটাই কোম্পানিগুলোর জন্য অধিক লাভজনক হতে পারে।
Writer – রাকিব অনিন্দ্য