গেল বেশ কয়েকমাস ধরেই পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া বড় বড় ব্যবসায়িক Scam বা ধোঁকাবাজীগুলো নিয়ে পড়াশুনা করেছি । নিতান্তই নিজের কৌতুহলের বসে । অনেকটা শখ করে বলতে পারেন । আশেপাশের এত বেশী ঠকা-ঠকির মচ্ছব চলছে যে জানতে মন চাইল কিভাবে লোকে ঠকে ? কেন ঠকে ? কিভাবে ঠকানো হয় ? ইত্যাদি, ইত্যাদি ।
.
বিস্তর পড়াশোনা আর Case study করে দেখলাম অন্ত:ত গেলো তিন-চারশ বছরে ঘটে যাওয়া স্ক্যামগুলো পাশাপাশি সাজালে একটি ধারা বা Pattern বের হয়ে আসে । কিছু কমন স্টেপস্ আছে, সেগুলো প্রায় প্রতিটা স্ক্যামেই কাজে লাগানো হয়েছে । একটি নির্দিষ্ট পথ আছে, যেটি ধরে এগিয়ে যাওয়া হয়েছে ধোঁকাবাজীর স্টেশনে । আমেরিকা, ভারত, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, পেরু, স্পেন, পাকিস্তান….সব জায়গায় ঘটে যাওয়া স্ক্যামগুলোতেই মূল সূত্রগুলো আদতে একই ! মধ্যযুগ হোক বা উপনিবেশিক আমল কিংবা বর্তমান সময় – সবকালেই, সব সমাজেই !
.
ধরে নিন আপনি একখানা স্ক্যাম করতে চাইছেন । কিভাবে করবেন ? স্টেপগুলো কি হবে ? প্লে-বুকটা কি হবে ?
জানতে চাইলে বসে পড়ুন । বলছি ।
.
তবে আগেই বলে নেই এই পুরো এ্যানালাইসিস এবং প্যাটার্ণটা আমার নিজের চিন্তা-ভাবনা এবং অবজার্ভেশন থেকে তৈরী । আপনি একমতও হতে পারেন, নাও হতে পারেন । কোনোটিতেই আমার কোনো সমস্যা নেই । আমি শুধু আমার কথাটা বলছি ।
.
শুনুন তবে ।
.
.
প্রথম স্টেপ
বড়সড় একখানা দান মারতে চান ? তবে আপনাকে অবশ্যই অনেক লোকের বসবাস আছে এমন জায়গায় জাল পাততে হবে । সেটি জনবহুল শহরও হতে পারে বা জনবহুল দেশ । আপনার বেছে নেয়া জায়গাটির লোকসংখ্যা যত বেশী হবে আপনার দান মারার সুযোগ এবং আকার দুটোই হবে তত বেশী । তাই আপনি কত টাকা স্ক্যামের মাধ্যমে তুলে নিতে চান, তার উপর নির্ভর করবে ঠিক কত লোকের শহরে বা দেশে আপনি খেলাটা শুরু করবেন ।
.
বেশী লোকসংখ্যা লাগবে কেন ?
.
তার কারণ হচ্ছে দুটি ।
.
প্রথমত: যে কোনো স্ক্যামই একসময় ধ্বসে পরতে বাধ্য । এটি কখনই টেকসই হয় না, কখনই না । আজ হোক, কাল বা পরশু স্ক্যাম ধরা পরবেই । তাই আপনাকে কাজ সারতে হবে দ্রুত । যেখানে বেশী মানুষ থাকে, সেখানে আপনার পক্ষে খুব দ্রুত বোকা বানাবার জন্য একসাথে অনেক মানুষকে পাওয়াটা সহজ হয় । যেকোনো স্ক্যাম মডেলের একটা টিপিং পয়েন্ট আছে । সাধারণভাবে যেটি হচ্ছে ‘আপনার স্ক্যামটি ততদিনই চলবে যতদিন আপনার কাছে ঠকে যাওয়া লোকের চাইতে তখনও না-ঠকা লোকের সংখ্যা বেশী থাকবে ।” যে মুহুর্তে এই ব্যালেন্সটি নষ্ট হয়ে যাবে, ঠিক সে মুহুর্তে স্ক্যাম মডেলটি আপনা হতেই ধ্বসে পরতে শুরু করবে । তাই লোক যত বেশী, আপনার স্ক্যামিং চালাবার সময়ও পাওয়া যাবে তত বেশী । অর্থাৎ, আপনার দান মারবার আকারটি হবে তত বড় ।
.
দ্বিতীয় কারণটা হলো যে জায়গায় লোক অনেক বেশী থাকে সেই সোসাইটি বা সমাজ ব্যবস্থা সাধারণত: সাইলো (Silo) টাইপের হয় । সোজা ভাষায় বললে সেই সোসাইটির ভেতর মানুষে মানুষে বন্ডেজ বা সবার সাথে সবার চেনাজানা কম থাকে । সেখানে ছোট ছোট গোষ্ঠী থাকে কিন্তু সবাই একসাথে কানেক্টেড থাকে না । অর্থাৎ, প্রতিটি মানুষের চেনা-জানা গন্ডীর বাইরে অনেক অনেক বেশী মানুষ থাকে । এর ফলাফল হিসেবে যখন স্ক্যামিং এর পাল্লায় পরে মানুষ টাকা পয়সা খোয়াতে থাকে, সেটি চট করে সবার নজরে আসতে সময় লাগে বেশী । অর্থাৎ, লোক জানাজানি কম হয় বা হতে সময় লাগে । তাই লোক ঠকানোর খেলাটা অনেক সময় ধরে চালু রাখা যায় সহজেই ।
.
মনে রাখতে হবে স্ক্যামিং করার পুরো প্রসেসে ‘সময়’ অন্যতম বড় ক্রিটিক্যাল একখানা বিষয় । আগেই বলেছি স্ক্যাম মডেল একসময় ধ্বসে পড়তে বাধ্য । তাই যত বেশী সময় পাওয়া যাবে, তত বেশী টাকা উঠিয়ে নেয়া সম্ভব হবে । বেশী লোকসংখ্যার শহর বা দেশ আপনাকে স্ক্যামিং এই সময়টা লম্বা করতে দারুণভাবে সাহায্য করবে । সাথে অনেক বেশী লোককে আপনার জালে ফাঁসাবার সুযোগতো আছেই ।
.
.
দ্বিতীয় স্টেপ
বিশ্বস্ত:তা তৈরী করুন । এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্টেপ । স্ক্যামিং-এ সফল হতে গেলে অতি অবশ্যই আপনার এটি লাগবেই । লোকে আপনাকে বিশ্বাস না করলে আপনার কথায় তারা পকেটের টাকা বের করে আপনাকে দিবে কেন ?
.
প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্বস্ত:তা তৈরী করবেন কিভাবে ? আপনি তো নতুন মানুষ, আপনার প্রতিষ্ঠানও নতুন । আপনার বা আপনার প্রতিষ্ঠান কারোরই কোনো ব্র্যান্ড ভ্যালু বা Reliability বা বিশ্বাসযোগ্যতা এখনও তৈরী হয়নি । তবে লোকে আপনাকে বিশ্বাস করবে কেন ?
.
সহজ বুদ্ধিটি হচ্ছে “আরেকজনের বিশ্বস্ততাকে কাজে লাগান ।” অনেকটা ‘গ্রোথ-হ্যাকিং’ ফর্মূলার মত ।
.
প্রতিটা সমাজে, শহরে, দেশে কিছু ব্যপার থাকে যাকে লোকে বিশ্বাস করে, ভরসা করে । সেই ব্যপারটি ব্যক্তি হতে পারে, প্রতিষ্ঠান হতে পারে, পদ-পদবী হতে পারে । ব্যক্তি বা পদ-পদবী হলে যেমন ধরুন শহরের মেয়র, বড় প্রভাবশালী লোকচেনা সাংবাদিক, কলাম লেখক, শিক্ষক, অব:সরপ্রাপ্ত বড় সেনা কর্মকর্তা বা বড় পাবলিক অফিসে কাজ করেছে এমন কেউ কিংবা বড় কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রী-স্টার খেলোয়ার-শিল্পী-আর্টিস্ট যার বিশ্বস্ততার ইমেজ আছে । এধরণের ইমেজওয়ালা লোকদের আপনার প্রতিষ্ঠানের মুখ হিসেবে ব্যবহার করুন । তবে শুধু গতানুগতিক ব্র্যান্ড এ্যাম্বেসেডর হিসেবে বিজ্ঞাপনেই নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা / অংশীদার হিসেবে । তাঁদেরকে ‘পেইড ডিরেক্টরশিপ’ দিতে পারেন । এতে করে সাধারণ মানুষ আপনার প্রতিষ্ঠানটি তখন আর শুধু আপনার বলে মনে করবে না, বরং ঐ বিশ্বস্ত মানুষগুলোর প্রতিষ্ঠান বলেও মনে করবে । আর ফলাফল হিসেবে আপনার প্রতিষ্ঠানও সেই ইমেজটুকুর সুবিধা পাবে । আস্তে আস্তে বিশ্বাস অর্জন করবে ।
.
এখনকার সময়ে এটি আরও সোজা তথাকথিত Social Media influencers-দের মাধ্যমে । লাখ লাখ বা মিলিয়ন মিলিয়ন ফলোয়ার আছে এরকম দু-একজন বেশ ভারী ধরণের influencers কে আপনার প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত করুন – Brand ambassador, Employee, Partner, Advisor, হ্যান-ত্যান যে কোনো একটা ডেজিগনেশন দিয়ে…….যে কোনোভাবে হলেই হলো । ব্যস্ । আপনার কড়িকাঠে জবাই করার জন্য লাখে লাখে বকরা সেই Influencer-রাই আপনার জন্য ধরে নিয়ে আসবে ।
.
কি চমৎকার বুদ্ধি তাই না ?
.
প্রতিষ্ঠান হলে সবচেয়ে ভাল হবে যদি কোনোভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে জড়িতে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান বা বাহিনীর সাথে কানেক্ট করতে পারেন । তাঁদের CSR ফান্ডে টাকা দিয়ে, তাঁদের জন্য স্থাপনা বানিয়ে দিয়ে, তাঁদের অনুষ্ঠানে-উপলক্ষ্যে স্পন্সর করে ইত্যাদি ইত্যাদি । তবে যাই করুন না কেন অবশ্যই এমনভাবে করবেন যেন সাধারণ মানুষ সেটি পরিষ্কার দেখতে পায় । ফান্ডে টাকা দিলে সেটি সাংবাদিক ডাকিয়ে ছবি-টবি তুলে ব্যপক পাবলিসিটি করে করবেন । স্থাপনা বানিয়ে দিলে সেটি এমন জায়গায় বা এমনভাবে দেবেন যেন সেখানে আপনার বা আপনার প্রতিষ্ঠান বা ব্র্যান্ডের নামখানা জ্বলজ্বল করে এবং লোকে জানে । উপহার দিলে গাড়ি বা এধরণের জিনিষ দেবেন, যেটি সাধারণ মানুষের চোখের সামনে থাকে । মূল কথা হচ্ছে যাই করুন লোককে দেখাবেন যে আপনি এই মানুষগুলো বা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে জড়িত । ১০০ টাকা তাঁদের পেছনে আসল কাজে খরচ করলে সাথে আরও ৫০০ টাকা খরচ করুন সবাইকে জানাতে যে আপনি ১০০ টাকা খরচ করেছেন । মানুষকে জানানোর জন্যই তো এত কিছু, তাই না ? তাই পাবলিসিটিতে কার্পণ্য করবেন না । কারণ, ঐ বিশ্বস্ত মানুষগণ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোই সাধারণ লোকের সামনে আপনার বিশ্বস্ততা তৈরী করবে । লোকে ভাববে আপনার প্রতিষ্ঠানটি যেহেতু এঁদের সাথে জড়িত সুতরাং এটি খারাপ বা ধোঁকাবাজ হতেই পারে না ।
.
.
এবার আসি তৃতীয় স্টেপে ।
এটিও কিছুটা দ্বিতীয় স্টেপের মত । তবে সূক্ষ্ণ একটি পার্থক্য আছে – আগেরটি ছিল প্রতিষ্ঠানের জন্য আর এটি আপনার ব্যক্তিগত পর্যায়ের জন্য প্রযোজ্য । শুনুন তবে ।
.
নিজেকে সমাজের প্রভাবশালী বলয়ের ভেতরে নিয়ে আসুন । শহরের বিখ্যাত ব্যবসায়ী, টাইকুন, রাজনীতিবিদ-মন্ত্রী-সচিব, আইনজীবি, খেলোয়ার, সরকারী বড় কর্মকর্তা, শিল্পী-সাহিত্যিক ইত্যাদি অর্থাৎ সমাজের কেষ্টু-বিষ্টুর সাথে বন্ধুত্ব করুন । একসাথে গল্ফ-দাবা খেলুন, ক্লাবে দেখা-স্বাক্ষাৎ করুন, আপনার ছেলে-মেয়ের বিয়ে-জন্মদিন বা সামাজিক অনুষ্ঠানে তাঁদের অতিথী হিসেবে নিয়ে আসুন । অবশ্যই নিশ্চিত করুন তাঁদের সাথে মানুষ যেন আপনাকে দেখে – যত বেশী জায়গায় সম্ভব, যত বেশী সম্ভব ।
.
এই স্টেপের উচ্চতম স্তর হচ্ছে সাধারণ আনুগত্য বা লয়ালিটি ছাড়িয়ে নিজের একখানা ‘Cult image’ প্রতিষ্ঠা করা । ব্যপারটা অনেকটা অন্ধ-বিশ্বাস তৈরী করার মত । একবার যদি খালি কোনোভাবে আপনি সেই Cult leadership স্তরে চলে যেতে পারেন, তবে আপনার এমন একদল ভক্ত তৈরী হবে, যাঁরা নিজেরা আপনাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস তো করবেই, এমনকি যে কোনো পরিস্থিতিতে আপনাকে ডিফেন্ডও করবে, আর সাথে সাথে continuously প্রচুর পরিমাণে ওয়ার্ড-অফ-মাউথ ছড়িয়ে বিশাল সংখ্যক লোক ফাঁসাতে সাহায্য করে চলবে । এদের কাছে আপনার প্রতিমূর্তিটা কিছুটা দেবতা-জ্ঞানের মত । যত যাই হোক, এরা আপনার উপর থেকে বিশ্বাস হারাবে না । আর যদি দেখেন কখনও এই অন্ধ-আনুগত্য একটু-আধটু টলে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে এদের সামনে এসে কিছু আবেগীয় কথাবার্তা বলবেন । ব্যস্ । ঔষধের প্রভাব আবার কাজ করতে শুরু করবে । এই সোসাল মিডিয়ার যুগে এটি খুব একটা বেশী কঠিন ব্যপার না ।
.
তবে এই পর্যায়ে খুব কম লোকই পৌঁছাতে পারে । ছোট-খাট Scamming scheme-এর রাম-শাম-যদু-মধু এখানে যেতে পারে না । তবে পৃথিবীতে যারা সফলতার সাথে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা-ডলারের বিশাল বিশাল স্ক্যাম করেছে, তাঁরা প্রায় সবাইই এরকম একটা ‘Cult personality’ তৈরী করেছিল । এমনকি এদের শিষ্যদের অনেকেই এখনও তাদের Enigmatic প্রভাবে মশগুল । চোখের সামনে লুটপাট করে চলে যাবার পরেও বা লুটপাট চালাতে থাকার পরেও এই শিষ্যকুলের কাছে এঁনারা এখনও প্রায় দেবতা-তূল্য ! কি অপরিসীম প্রভাব ! একবার চিন্তা করে দেখুন !!
.
তবে অতখানি সুউচ্চ স্তরে আপনি যদি নাও উঠতে পারেন, শুধু যদি নিজেকে সমাজের প্রভাবশালী বলয়ের ভেতরেও নিয়ে আসতে পারেন, তবুও এই স্টেপে লাভ দুটো ।
.
প্রথমত: এতে করে সাধারণ মানুষের মনে ব্যক্তিহিসেবে আপনার নিজস্ব: একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরী হবে । লোকে ভাববে যে লোক এরকম কেষ্ট-বিষ্টুদের সাথে ওঠাবসা করে সে লোক নিশ্চয়ই ধোঁকাবাজ হতে পারে না । এতে করে আপনার জালে সাধারণ লোকদেরকে ফাঁসাতে সুবিধা হবে ।
.
আর দ্বিতীয়ত: লাভটি হচ্ছে যখন আপনার স্ক্যাম মডেলটি ধ্বসে পরা শুরু করবে তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত অথোরিটি আপনার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবার আগে দশবার ভাববে । কারণ তারাও জানে যে আপনি ওমুক-ওমুকের বন্ধু বা স্বজন বা পরিচিত । ভেবেটেবে যতক্ষণে তারা আপনার বিরুদ্ধে কিছু একটা করবে ততক্ষণে আপনি অনেকটা সময় পেয়ে যাবেন হয় আরও বেশী কিছু দান মারতে, কিংবা পগার পার হতে । ব্যস্, তারপর আপনাকে আর পায় কে !
.
সুতরাং, প্রভাবশালী সার্কেল গড়তে এবং নিজের পার্সোনালিটি তৈরী করতে বিনিয়োগ করুন । সময় এবং অর্থ দুটোই । আপনার সার্কেল যত বড় হবে, আপনার পার্সোনালিটি যত শক্তিশালী হবে, আপনার বিশ্বস্ততা তত বেশী হবে এবং যেকোনো অথরিটির আপনার কাছে পৌঁছাতে তত দেরী হবে । একাধারে আপনার ঘোঁট পাকাবার আকার এবং Escape route দুটোতেই এই স্টেপটির গুরুত্ব অপরিসীম ।
.
.
চতুর্থ স্টেপ
স্বপ্ন দেখান । যত বড় দান মারতে চান, তত বড় স্বপ্ন দেখান ।
.
কথায় বলে ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।’ সুতরাং, মানুষকে স্বপ্ন দেখান, যেন স্বপ্নের পেছনে দৌড়ে সে তার সঞ্চয়-জমি-জিরাত এমনকি পারলে ভিটে-মাটি বেচে আপনার হাতে টাকা তুলে দেয় । এর জন্য দরকার আপনার প্রতিষ্ঠানটির সাথে তার স্বপ্নের একটা যোগাযোগ, যেন সে নিজেকে আপনার প্রতিষ্ঠানের অংশ হিসেবে মনে করে, প্রতিপক্ষ বা ভিন্ন আরেক পক্ষ নয় । এটি করার জন্য তাই তার মাথায় এমন একটি স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিন, যেন সে নিজেকে আপনার প্রতিষ্ঠানের একজন বলে ভাবতে শুরু করে । বিশেষত: ভারতবর্ষে এই আবেগীয় স্টেপটি খুব কার্যকর । এর সফল প্রয়োগ করেছে ছোট ছোট স্ক্যামার থেকে শুরু করে বড় বড় স্ক্যামিং গুরুরাও ।
.
এই স্বপ্ন দেখাবার একটি চমৎকার উপায় হলো কমিউনিটি তৈরী করা । যখন একই স্বপ্ন দেখা অনেক লোকজন একসাথে হয় তখন সেই সম্মিলিত স্বপ্নের শক্তিটা আরও বহুগুণে বেড়ে যায়, বহুগুণে ছড়িয়ে পরে । তাই আপনার পুরো Scamming scheme টা শুরু করার আগে কি স্বপ্ন বিক্রি করবেন সেটি ঠিকঠাক মত নির্ধারণ করুন । আপনার দেখানো স্বপ্নটি যত শক্তিশালী এবং আপনার শিকারের জীবনে যত Touching & Relevant হবে, তাঁদেরকে ফাঁসানো আপনার জন্য তত সহজ হবে । তবে স্বপ্ন শুধু তৈরী করলেই হবে না, বরং তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে মানুষের মধ্যে । এই কাজটি করার জন্য ব্যবহার করুন কম্যুনিকেশনের ক্ষমতা । প্রতিষ্ঠানের ‘ট্যাগলাইন-শ্লোগান’ ক্র্যাফট করুন এভাবে যেটি আপনার দেখানো স্বপ্নটি বার বার মনে করিয়ে দেয় । প্রতিটা এ্যাডভার্টাইজমেন্ট, প্রতিটা ইভেন্ট, প্রতিটা PR occasions, এমনকি প্রতিটা CSR activities গুলোও যেন আপনার দেখানো স্বপ্নটিকে বার বার reinforced করে । মনে রাখবেন স্বপ্নটি যতক্ষন ধরে রাখতে পারবেন, আপনার জালে ধরা খেতে লোকজন আসতেই থাকবে । তাই শক্তিশালী এবং রিলেভেন্ট একটা স্বপ্ন দেখানোটা যে কোনো স্ক্যামিং স্কিমিং এর একখানা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ।
.
.
পঞ্চম এবং শেষ স্টেপ ।
বরশি দিয়ে মাছ মারতে দেখেছেন ? না দেখলে দেখে আসুন । বরশি পাতার আগে শিকারীরা ‘চারা’ নামের একটা জিনিষ পুকুরের নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে । ‘চারা’ হচ্ছে খুব গন্ধযুক্ত মাছের খাবারের মত এক প্রকারের মিশ্রণ । পানিতে পরার পর এটি চারপাশে খুব দ্রুত গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে মাছকে সেখানে টেনে নিয়ে আসে । যেখানে ‘চারা’ ফেলা হয়েছে শিকারী ঠিক সেখানেই বরশি পাতে । চারা’র গন্ধের টানে মাছ এসে বরশিতে মুখ দেয় । তারপর আর কি ? ধরা !
.
আপনার স্ক্যামের জালের জন্য ঠিক এরকমই ‘চারা’ ফেলুন । কিভাবে ? আপনার প্রথম দিককার কাস্টোমাররাই আপনার ‘চারা’ । এদেররকে ঠিকঠাক মত খুব চমৎকার সার্ভিস দিন । এমনভাবে এদেরকে খুশী করে দিন যেন তারা গিয়ে আপনার ব্যপারে আরও ১০ জনকে ভাল ভাল কথা বলে বেড়ায় । এখনকার সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । তাই এদিকে খুব করে নজর দিন । আপনি ঠিক কত বড় দান মারতে চান এবং কত বেশী লোককে ফাঁসাতে চান, তার উপর নির্ভর করে চারা’র সময় নির্ধারণ করতে হবে । যত সময় দিবেন তত বেশী লোক আপনার জালে আসবে । অবশ্য শুরুতে তত বেশী ইনভেস্টমেন্টও আপনার করতে হবে – কারণ তত বেশী লোককে আপনার শুরুতে খুশী করতে হবে একদম ঠিকঠাক সার্ভিস দিয়ে ।
.
যখন আপনি যতখানি চান, ততখানি একটা বড়সড় গ্রুপ তৈরী হয়ে যাবে যারা পজেটিভ কথা-বার্তা, আলোচনা (Words of mouth), recommendations ইত্যাদি দিতে থাকবে, বুঝবেন টোপ খাওয়ার জন্য অনেক মাছ আসছে । তখন আস্তে আস্তে জাল গোটাবার প্রস্তুতি নিন ।
.
তবে সব জাল একসাথে টানবেন না । কিছু টানুন, কিছু ‘চারা’ তৈরী করতে ব্যবহার করতে থাকুন । ধরুণ প্রতি ১০ জনে ৭ জনকে ফাঁসাবেন, আর ৩ জনকে সার্ভিস দিয়ে খুশী করে দিবেন । এই ৩ জন আরও নতুন ১০ জন মক্কেল নিয়ে আসবে । এভাবেই খেলা চলতে থাকবে । আর টাকাও আসতে থাকবে ।
.
.
……………ব্যস্ ! হয়ে গেল । আমার এ্যানালাইসিস এবং প্যাটার্ণখানা এখানেই শেষ ।
.
খুব সহজ না ? আসলেই খুব সহজ । স্টেপগুলো আমার দৃষ্টিতে আসলে জটিল কিছু না । খুব একটা বেশী অজানাও নয় । মজার ব্যপার হলো তারপরও যুগে যুগে লাখে লাখে মানুষ এই সহজ স্টেপের কাছেই ফিরে ফিরে বারবার বোকা হয়ে ফেঁসে গিয়ে কপাল চাপড়িয়েছে, এখনও চাপড়াচ্ছে এবং আমি নি:শ্চিত ভবিষ্যতেও চাপড়াবে !
.
এর কারণ কি ?
.
কারণ হচ্ছে এই পুরো প্যাটার্ণখানায় মূল জ্বালানী হিসেবে মানুষের ‘আদি এবং অকৃ্ত্রিম একখানা প্রবৃত্তি (Basic instinct)’ ব্যবহার করা হয় ।
.
সেটি হচ্ছে ‘লোভ’ ।
.
লোভ হচ্ছে এমনই আদি একখানা প্রবৃত্তি যা স্বয়ং আদমকেও স্বর্গের সুখ থেকে বের করে এনেছিল ! সেখানে আমরা মর্ত্যের সাধারণ মানুষ কোন ছার !
.
সে সমাজে লোভ যত বেশী, সে সমাজে স্ক্যাম করার সুযোগ তত বেশী । যেখানে লোকে যত দ্রুত বড়লোক হতে চায়, সেখানে স্ক্যাম হয় তত বেশী । তাই খেয়াল করে দেখলাম প্রতিটা শহরের বা দেশের বড় বড় স্ক্যামগুলো সংঘটিত হয়েছে সেই সময়েই যখন শহর বা দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তন হওয়া শুরু হয়েছে । অর্থাৎ, ঠিক যখন গরীব থেকে কিছুটা হলেও লোকে বড়লোক হওয়া শুরু হয়েছে । সমাজের কিছুটা অংশ যখন অনেক ধনী হয়ে যায়, বাকি অংশটি তখন সাধারণভাবেই ধনী হতে খুব মরিয়া হয়ে ওঠে । সুতরাং, তাঁদের সামনে তখন বড়লোক হবার যে টোপই ফেলা হোক না কেন, বেশী বাছবিচার না করে তারা সেটি গপ করে গিলে খাবেই । স্ক্যামারদের স্বর্গ ঠিক এরকম একটা সমাজ এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ।
.
একবার যখন পুরো শহর বা দেশের সমাজ মোটামুটি একটা অর্থনৈতিক সমতলে বা অন্ত:ত বেসিক চাহিদাগুলোর নিশ্চয়তায় দাঁড়িয়ে যায়, তখন মানুষের মনে মরিয়াভাবটা কমে যায় । তখন সে চিন্তাভাবনা করে পদক্ষেপ নেয় । তখন তাকে ফাঁসানোটা কঠিন হয়ে পরে ।
.
তাই আপনাকে ঠিক ঠিক সময়ে ঠিক ঠিক একটা সমাজ খুঁজে বের করতে হবে, যেটির অর্থনৈতিক পরিবর্তন হওয়া শুরু হয়েছে । সেই সমাজের যথেষ্ট পরিমান লোভী এবং কৌতুহলী মরিয়া লোক আপনার বাকী কাজটা সহজেই করে দেবে ।
.
এই হলো সহজ কথায় যাকে বলে ‘প্রিন্সিপ্যালস-অফ-স্ক্যামিং’ বা ‘প্লে-বুক অফ স্ক্যামিং’। বিশ্বাস না হলে গেল কয়েক শতকের সবচেয়ে বড় বড় স্ক্যামের কেসগুলো পড়ে আসুন । সাথে বেসিক হিউম্যান সাইকলজিটা পড়ুন । তারপর দরকার পরলে আমাদের দেশের অতীতে ঘটে যাওয়া এবং বর্তমানেও ঘটতে থাকা স্ক্যামিং-গুলোর প্যাটার্ণগুলো খেয়াল করুন । তারপর আমার Analysis খানা আবার পড়ে দেখুন । আমি নিশ্চিত লোক ঠকানোর খেলাটা আর দুর্বোধ্য কিছু লাগবে না ।
.
যা হোক, ফর্মূলা তো জানিয়ে দিলাম । এখন যদি আপনি এটিকে প্রয়োগ করে বড়লোক হতে চান সেটি আপনার অভিরুচি, ঝুঁকি নেবার মানসিকতা এবং নৈতিকতা ।
.
কথায় বলে “চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা ।” এখন এই চুরি বিদ্যায় প্রয়োগ করতে গিয়ে আপনি ধরা পরবেন কি না সেটি নির্ভর করবে আপনার দক্ষতা এবং তীক্ষ্ণতার উপর । ধরা খেয়ে গেলে কিন্তু আমাকে দোষ দেয়া যাবে না । আগেই বলে রাখছি ।
.
.
এবার টেবিলের উল্টোপাশের লোকদের কথা বলি । অর্থাৎ, ফেঁসে যাওয়া কিংবা সামনে ফাঁসতে যাওয়া সাধারণ জনগণ ।
.
ওহে জনসাধারণগণ
আপনারা এত বোকা আর লোভী কেন ?
.
উপরের স্টেপগুলো পড়ুন, লক্ষ্ণণগুলো জানুন, বুঝুন । কোথাও কোনো Scheme বা Offer দেখলেই সবভুলে দৌড় দেয়াটা বন্ধ করুন । টাকা ইনকাম করাটা মোটেও সহজ কাজ নয় । বিশাল সব বড় বড় এবং সফল প্রতিষ্ঠানও তার বিনিয়োগকারীদের ১০-২৫% এর বেশী লাভ দিতে পারে না । ইউরোপ-আমেরিকায় ১০-১২% লাভ দেয়াটা বিরাট ব্যপার, খুব কম প্রতিষ্ঠানই তা দিতে পারে । বাংলাদেশে এমনকি সরকারী বন্ডের প্রফিট রেটও ১০-১২% এর বেশী নয় । যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রোডাক্ট তৈরী করে, তারা এমনকি ব্যালেন্সশীটে ১০-১৫% নেট প্রফিট আনতেই নাকানি-চুবানি খেয়ে যায় । বাংলাদেশে FMCG, Electronics, Machineries ইত্যাদি ইন্ডাস্ট্রির নেট প্রফিট দুই-অংকের ঘরে টিকিয়ে রাখতে ভীষণ হাড়ভাঙ্গা কষ্ট করতে হয় । সেখানে কেউ যদি আপনাকে কয়েক মাসে টাকা কয়েকগুণ করে দিবে বা ৪০-৫০% ডিসকাউন্টে জিনিষ দেবে বলে ডাক দেয়, তাহলে প্রশ্ন করতেই হয় তার হাতে কোন ‘আলাদীনের চেরাগ’ খানা আছে !?! আর তাঁর ব্যবসার বুদ্ধিখানা যদি এতই অসাধারণ চমৎপ্রদ হয় যে সেটি মার্কেটের নরমাল রিটার্ন রেটকে এতগুণ বেশীতে অতিক্রম করতে পারে, তবে সে এখনও জেফ বেজোস, ইলোন মাস্ক, ওয়ারেন বাফেট বা বিল গেটসকে অতিক্রম করে বিশ্বের সেরা ধনী হয়ে যায় নি কেন ?
.
ব্যবসা কি এতই সহজ । টাকা কি এভাবে কখনও মাসে মাসে লাফিয়ে লাফিয়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে বাড়তে থাকে ? এটি কি আদৌ কোনো Sustainable model ? কখনই সেটি হওয়া সম্ভব নয় । তার মানে এই মডেলের অংশ হিসেবে কেউ না কেউ অবশ্যাম্ভাবী ভাবে ধরা খাবে । সেই ‘কেউ’টা যে ‘আপনি’ হবেন না, তার গ্যারান্টি কি ?
.
আপনি হয়ত মনে মনে ভাবছেন অন্য কেউ ধরা খাবে, আপনি খাবেন না । মজার ব্যপার হলো ঠিক এই ভাবনাটাই অন্য সবাইও ভাবছে । সুতরাং, অন্যদের হিসেবে ধরা খাওয়াটা লোকটি হচ্ছেন আপনিই, আপনার হিসেবে অন্যরা যা । অর্থাৎ, দিন শেষে সবাই ধরা খাচ্ছেন, বাদ যাচ্ছে না কেউই । পরিষ্কার এবং সহজ হিসাব ।
.
তাই জেনেশুনেও যদি আপনি গোবেচারা ছাগশিশুর মত কশাইয়ের কড়িকাঠে গলা পেতে দেন, তবে আপনার গলাখানা কাটা পরাই উচিৎ এবং স্বাভাবিক । লকলকে লোভ থেকে নিজের নলাটুকুকে সামলে রাখুন । না হলে ধরা তো খাবেনই । আপনাকে বাঁচাবে কে ? আপনার সর্বনাশ তো আপনি নিজেই ডেকে এনেছেন ! আর কেউ নয় ।