লেখকঃ অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ম্যান্ডারিন ভাষায় সংকট একটি যুক্ত শব্দ। প্রত্যেকটি শব্দের জন্য একটি প্রতীক ব্যবহৃত হলেও ম্যান্ডারিন ভাষায় সংকট লিখতে দুইটি প্রতীক সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। দুইটি প্রতীকের প্রথমটি হুমকী লিখতে, দ্বিতীয়টি সুযোগ লিখতে ব্যবহৃত হয়। বিশ্ব মহামারী করোনার কারণে বাজারজাতকরণ মহা সংকটে আছে। আবার এই সংকটকেই সুযোগ হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করতে হবে বাজারজাত করণের সাথে সংশ্লিষ্টদের।
রিসেশন( পড়তি) আর ডিপ্রেশনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ” যখন দেখবেন আপনার পাশের দোকান বা ব্যবসায়টি বন্ধ হয়ে গেছে সেটা হল রিসেশন; আর আপনার দোকান বা ব্যবসায়টাও যখন বন্ধ হয়ে যাবে তখন তা ডিপ্রেশন। ” ইতিহাসে বহু মন্দা এসেছে এবং চলেও গেছে৷ মন্দার পরই আবার বাজার ঘুরে দাঁড়ায়। করোনা সৃষ্ট মন্দা থেকেও একদিন পৃথিবী ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু অনেকেই মনে করে সে বিশ্ব হবে বদলে যাওয়া এক বিশ্ব। মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কির মতে, “… এই পৃথিবীর ভুলগুলো বুঝতে সহায়ক হবে। অকার্যকর আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার গভীরে তাকানোর সুযোগ দেবে। যার পরিবর্তন আবশ্যক, যদি আমরা চাই একটি বাসযোগ্য পৃথিবী।”
অর্থনীতির ভালো সময়ে বাজারীরা ভুলে যায় তাদের বিক্রয় বৃদ্ধি কেবলমাত্র তাদের সফল বিজ্ঞাপন ও আবেদনময়ী পণ্যের আকর্ষনে নয়। ভোক্তার ক্রয় নির্ভর করে ইচ্ছেমতো ব্যয়ের জন্য পর্যাপ্ত আয় ( ডিসক্রেশনারী ইনকাম), ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার অনুভূতি, ব্যবসা ও অর্থনীতির উপর আস্থা, এবং তাদের জীবন ধাঁচ ও মূল্যবোধ দ্বারা ভোগ প্রবাহিত হয়।
আমেরিকার ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ রিসেশনের পদচিহ্ন দেখার জন্য নিম্নোক্ত অবস্থাকে বুঝিয়েছেন, ” Significant decline in economic activity spreads across the economy, lasting more than a few months.”
আরেকটি সংজ্ঞা হচ্ছে, GDP তে পরপর দুই কোয়ার্টার ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দিলেই মন্দা বলা যাবে। সংজ্ঞা যেটাই ধরি না কেন, ফল একইঃ চাকরি হারানো, প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, শিল্প উৎপাদনের গতি মন্থর হওয়া, ভোগ ব্যয়ের আধোগতি, চাহিদা হ্রাস এবং অনিশ্চয়তার ভয়। মন্দার প্রায় সবকটি লক্ষ্মণ বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশেও এ সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, বেকারের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়া, অথবা কর্মহীন হওয়ার ভয়ে খরচ কমিয়ে দেওয়া, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় আরো কমে যাওয়া; সব লক্ষ্মণ নিয়েই একটি দীর্ঘমেয়াদী মন্দার কবলে পড়ার আশঙ্কা প্রায় বাস্তব হতে চলছে বাংলাদেশে।
এই সংকটকালে মার্কেটিং এর লোকজন কী করবে? পেশাদার মার্কেটার্সদের প্রথম কাজ হচ্ছে কোম্পানিকে টিকিয়ে রাখা। ACI গ্রুপের কনজুমার ব্রান্ডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ আলমগীর সম্প্রতি যেমনটা বলেছেন, ” বেঁচে থাকলে মুনাফা করা যাবে। ” এই বেঁচে থাকা বলতে তিনি কোম্পানি, কর্মচারী, ক্রেতা এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদেরকে বুঝিয়েছেন। চাহিদা কমে গেলে উৎপাদন কমে যাবে বা বন্ধ হয়ে যাবে; ফ্যাক্টরি বন্ধ হলে উৎপাদন ও বিতরণের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের চাকরি সংকটে পড়বে। অনেক কোম্পানি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কর্মচারীর সংখ্যা কমিয়ে অল্প লোক দিয়ে বেশি কাজ করাতে চাইবে। এতে বেকারত্ব বাড়বে, বেকারত্ব বাড়লে, বাজারে ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে আংশিকভাবে চালু উৎপাদন ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কর্মচারী ও কোম্পানি মিলে ঠিক করবে চাকরি ও কোম্পানি বাঁচানোর পদ্ধতি। আমাদের দেশের অনেক কোম্পানির নির্বাহীরা তাদের বেতনের কিছু অংশ ত্যাগ করলেও নিম্ন বেতনের অনেক কর্মচারীর চাকরি বেঁচে যাবে। ক্রেতাকে বাঁচাতে পণ্যমান ও সেবার অগমেন্টেড অংশটুকু বাদ দেওয়া যেতে পারে। কোর বেনিফিট, মৌলিক পণ্য, এবং ক্রেতার প্রত্যাশার বাইরে যা যোগ করা হচ্ছে তা পরিহার করা গেলে পণ্যদাম কমানো সম্ভব হবে।
টুথ পেস্টের কাগজের হার্ড প্যাকেট বাদ দিয়ে কেবল একই মানের টিউবটা রাখলে টুথপেষ্টের দাম ৫/১০ টাকা কমানো যাবে। যেহেতু ক্রেতার আরাধ্য পণ্যটা একই থাকছে, সেহেতু দাম কমালে মান নিয়ে তাদের কোন সন্দেহ হবে না। অনেকক্ষেত্রে আগের দামে আগের সাইজের প্যাকেটে কম পণ্য দিয়েও সমস্যা মোকাবেলা করতে দেখা গেছে। বিজ্ঞাপন খরচ কমিয়ে বিজ্ঞাপনের সাশ্রয়ী টাকা বাজারজাতকরণ মিশ্রণের অন্যান্য উপাদানে পুনঃবন্টন করা যেতে পারে। মন্দার সময়ও যেসকল পন্যের বিক্রয় আগের মত থাকে সেগুলো হল ভোক্তার আবশ্যকীয় পণ্য বা Consumer staples. যেমন, টুথপেষ্ট, সাবান, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট, থালা বাসন ধোয়ার সাবান, টয়লেট পেপার, টিস্যু ইত্যাদি। অর্থনৈতিক খারাপ অবস্থাতেও পুরুষ ও মহিলারা তাদের সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রে তাদের ভাল দেখা যাক এটা চায়, তাই কসমেটিক বা এ জাতীয় পণ্যের চাহিদা মন্দার সময়ও খুব বেশি কমে না। ACI, MGI বা বসুন্ধরা গ্রুপের মত কনগ্লোমারেট ব্যবসায় হাউসগুলো ক্রস সাবসিডাইজেশনের পথ ধরতে পারে। অর্থাৎ এক খাতের আয় দিয়ে অন্য খাতকে আপাতত টিকিয়ে রাখা।
কিছুকিছু ব্যতিক্রম দাঁড়ায়, মন্দার সময় চাহিদা হ্রাস মূল্য হ্রাসের তীব্র চাপ সৃষ্টি করে। তবে মজার ব্যাপার হল, মন্দার সময় চাহিদার মূল্য স্থিতিস্থাপকতা বাড়ে। মূল্য হ্রাস করলে স্বাভাবিকের চেয়ে চাহিদা বেশি বাড়ে। তখন কোম্পানি তার আটকে পড়া পণ্য বিক্রয় করে ক্যাশ টাকার ঘাটতি কমিয়ে কোম্পানিকে ব্যবসার বাইরে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। যেমন সুপার চেইন ‘স্বপ্ন’ করেছে, দীর্ঘদিন লোকসানে থাকা কোম্পানিটির টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
মন্দার সময় পণ্যের দামের ব্যাপারে কৌশল ঠিক কী হবে তা অনেকাংশেই পণ্যের ধরনের উপর নির্ভর করে। অত্যাবশ্যকীয় সাধারণ বা কম মানের পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাবে বা অপরিবর্তনীয় থাকবে তাই দাম কমানোর প্রয়োজন নেই। বিলাস দ্রব্য যেগুলোর ক্রয় বিলম্বিত করা যায় তার চাহিদা কমে যাবে। এসকল পণ্যের মূল্য হ্রাস করে ক্যাশফ্লো অব্যাহত রাখা যায়। সমহারে মূল্য স্থিতিস্থাপক পণ্যের মূল্য হ্রাস করে কোন লাভ হবে না। এক্ষেত্রে মূল্য প্রতিযোগিতা অস্ত্র ছাড়াও অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন- লয়েল্টি কার্ড, উন্নততর বিক্রয়োত্তর সেবা।
মন্দাকালীন সময়ে কার্যকর পাঁচটি বিক্রয় কৌশল হচ্ছে–
১. সম্ভব হলে পন্যের অবমূল্যায়ন না করা। এমনটি করলে ক্রেতা মনে করতে পারে কোম্পানিটি আগে অধিক মূল্য নিয়ে তাকে ঠকিয়েছে। মূল্য হ্রাসের চেয়ে অধিক সময়ের গ্যারান্টি অথবা কারিগরি সহায়তা বাড়িয়ে ভাল ফল পাওয়া গেছে।
২. শান্ত থাকা এবং পণ্যের চেয়ে সমাধানের প্রতি বেশি মনযোগী হওয়া, বিক্রয়কর্মীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যেন অতিমাত্রায় এগ্রেসিভ বা বিক্রির জন্য মরিয়া হয়ে না উঠে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৩. অল্প সংখ্যক সম্ভাব্য ক্রেতার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। তবে তাদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে।
৪.পুরাতন ক্রেতাদের প্রতি মনোযোগ কমানো যাবে না।মনে রাখতে হবে নতুন ক্রেতা ধরার চেয়ে পুরনো ক্রেতা ধরে রাখা কম ব্যয়বহুল।
৫.বিক্রয়কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রেষণা ও প্রণোদনার মাধ্যমে পেশাগত মানোন্নয়নের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।